চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

মিতু হত্যা মামলা

চার বছরেও জানা যায়নি কার পরিকল্পনায় খুন

আদালতের নির্দেশে মামলাটি এখন পিবিআই’র তদন্তাধীন, ধরাছোঁয়ার বাইরে মুছা

নিজস্ব প্রতিবেদক

৬ জুন, ২০২০ | ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে
মেয়ে হত্যার বিচার চাই’

লাল ফিতায় বাধা চাঞ্চল্যকর সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলা। মিতুকে কার পরিকল্পনায় খুন করা হয়েছে চার বছরেও জানতে পারেনি তদন্ত সংস্থা। কামরুল শিকদার ওরফে মুছাকে না পাওয়া পর্যন্ত উন্মোচন হচ্ছে না মিতু হত্যার রহস্য।
আদালতের নির্দেশে মামলাটি এখন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তাধীন। তবে মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে চলেছেন, বাবুল আক্তারই মিতুর হত্যাকারী।
মোশাররফ হোসেন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বলেন, ‘আমি বাবা। আমার মেয়েটাকে কারা খুন করল, সেটা কি আমার জানার অধিকার নেই? আমার মেয়ের খুনের বিচার পাবার অধিকার কি আমার নেই ? আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছেও যদি বিচার না পাই, এই বিচারের ভার আমি আল্লাহর কাছে দিলাম’।
২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে নগরীর জিইসি মোড়ে নিজ ভাড়া বাসার কিছু দূরে গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। গতকাল (শুক্রবার) এ ঘটনার চারবছর পূর্ণ হয়েছে। নগর পুলিশের (সিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ মামলাটি সাড়ে তিনবছর ধরে তদন্ত করে। কার্যত কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেওয়া হয়। তবে গত পাঁচমাসেও পিবিআই মামলার তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেনি বলে জানা গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, আদালতের নির্দেশে আমরা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেছি। এখন এটি তদন্তের পর্যায়ে আছে।
গত চারবছরের প্রায় পুরো সময়জুড়ে মামলাটির তদন্তভার ছিল সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের কাছে। তিনি বলেন, গত জানুয়ারিতে আদালত সুয়োমেটো জারি করে মামলার তদন্তভার পিবিআইকে দিয়েছেন। এরপর আমরা সব নথিপত্র পিবিআইকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
তবে মামলার তদন্তভার পিবিআইয়ে যাবার পরও ন্যায় বিচারের কোনো আশা দেখছেন না মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, নিয়ম হচ্ছে মামলার তদন্ত সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে সেটা বাদি কিংবা বাদিপক্ষ অথবা ভিকটিমের পরিবারকে জানাতে হবে। বাদি বাবুল আক্তার নিজেই সন্দিগ্ধ। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যতো মিতুর বাবা হিসেবে আমাকে বিদায়ী তদন্ত কর্মকর্তা অথবা নতুন তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো উচিৎ ছিল। তারা তা জানায়নি।
২০১৬ সালে হত্যাকা-ের বছরখানেক পর থেকেই মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে আসছিলেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে মিতুকে খুন করা হয়েছে।
হত্যাকা-ের পরপরই বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ তোলেননি কেন, জানতে চাইলে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাবুলের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধব, এর মধ্যে পুলিশ আছে, সাংবাদিকও আছে, তারা শুরু থেকেই আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। পরে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, তারা আমাদের সামনে ভালো সেজে আমাদের গতিবিধি অনুসরণ করছে। পরে সেটা বাবুলকে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। সেটা জানার পর আমি তাদের এড়িয়ে চলা শুরু করি। তখন আমার সামনে অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়’।
এ ধরনের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি। ফলে এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানা সম্ভব হয়নি। গত চারবছর ধরে অনেকটা নিশ্চুপ আছেন মামলার বাদি বাবুল আক্তার। পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকার মগবাজারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি।
পুলিশের তদন্তে আস্থা না থাকার কথা জানিয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি নিজে পুলিশ অফিসার ছিলাম। আমি অনেক মামলা তদন্ত করেছি। আমার ধারণা, মিতু খুন হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই তদন্তে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক কিছু জানতে পারেন। তারা জানতে পারেন, বাবুল আক্তার হত্যাকা-ে জড়িত। কিন্তু এরমধ্যেই কিছু ভুলত্রুটি তারা করে ফেলে, যেটা তারা প্রকাশ করতে পারেননি। একটি ঘটনা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি আরও পাঁচটি ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়, সেই ভয়ে তারা চুপ করে থাকেন। গত চারবছরে তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার নথিতে চারটি লাইন যোগ করেছেন কি না আমার সন্দেহ’।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে মিতু খুন হবার ঘটনায় ওই বছরের ৮ জুন ও ১১ জুন নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারী উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতলঝর্ণা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিতু হত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
ওই বছরের ২৪ জুন রাতে ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর ফলে সন্দেহের তীর যায় বাবুলের দিকে। হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদও প্রকাশিত হয়। এসময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন।
মাহমুদা হত্যাকা-ের তিন সপ্তাহ পর মো. ওয়াসিম ও মো. আনোয়ার নামের দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁরা বলেন, ‘কামরুল শিকদার ওরফে মুছার নেতৃত্বে হত্যাকা-ে তাঁরা সাত-আটজন অংশ নেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে বাবুল চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় মুছা তাঁর ঘনিষ্ঠ সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। পরে মুছার সন্ধান চেয়ে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে নগর পুলিশ।
মাহমুদা খুন হওয়ার ১৭ দিন পর মুছাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় বলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানান মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার। তবে পুলিশ বরাবরই মুছাকে গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে আসছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মাহমুদা হত্যায় অংশ নেন ওয়াসিম, আনোয়ার, মো. রাশেদ, নবী, মো. শাহজাহান মিয়া, মুছা ও মো. কালু। হত্যাকা-ের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে সন্ত্রাসী এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা। তাদের মধ্যে নবী ও রাশেদ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। মুছা ও কালু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, এহতেশাম সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট