চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

নমুনা জটের মধ্যেই আরও নমুনা সংগ্রহের বুথ!

ইমাম হোসাইন রাজু

৩ জুন, ২০২০ | ৬:৪৭ অপরাহ্ণ

হাসিনা বেগম। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী। করোনা উপসর্গ নিয়ে তার মৃত্যু হয় গত সোমবার। কিন্তু তখন পর্যন্ত অজানা ছিল ওই স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা। যদিও মৃত্যুর চারদিন আগেই এ নারীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। মৃত্যুর একদিন পর তার নমুনার ফলাফলে জানা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এই স্বাস্থ্যকর্মীর নমুনার ফল দেরিতে পাওয়ার কারণ করোনা পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ল্যাবগুলোতে ‘নমুনা জট’।

নমুনা জটের এ নজির শুধু আলোচ্য স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যাপারেই নয়। একই রকম জটের মধ্যে আটকে আছে মৃত অনেক ব্যক্তির নমুনা। এমনকি আক্রান্তদের অনেকেই নমুনা দিয়ে অপেক্ষায় আছেন ফলাফল জানার জন্য। গড় একটি হিসেবে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে নমুনা সংগ্রহের পর ফলাফল জানতে চার থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। বিদ্যমান এমন নমুনা জটের মধ্যেই চট্টগ্রামে নতুন করে ১৯ টি করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ বসানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, নমুনা পরীক্ষা করার জন্য নতুন করে জনবল বৃদ্ধি ও পরীক্ষাগার বাড়ানোর পদক্ষেপ না নিয়ে নমুনা সংগ্রহের বুথ বাড়ানো হলে জট পরিস্থিতি আরও বাড়বে। ভোগান্তিতে পড়বেন রোগীরা। তাই সংগ্রহের বুথ স্থাপনের আগে নমুনা পরীক্ষার জন্য টেকনিশিয়ান ও মেশিনসহ আরও ল্যাব বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ।
খবর নিয়ে জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর গত ২৫ মার্চ ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতালের ল্যাবে শুরু করা হয়। একমাস পর ২৫ এপ্রিল শুরু করা হয় ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু)। সর্বশেষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেও গত ৯ মে পরীক্ষার কাজ শুরু হয়। তবে এদের মধ্যে শুধুমাত্র বিআইটিআইডি ল্যাবে সরাসরি নমুনা সংগ্রহ করলেও বাকিগুলো কোনটিই করা হয় না। সিভাসুতে পরীক্ষার জন্য বিআইটিআইডি ও বিভিন্ন জেলা থেকে নমুনা প্রক্রিয়াজাত করে পাঠানো হয়। আর চমেকের ল্যাবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও চমেক হাসপাতালে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সব মিলিয়ে গড়ে এ তিনটি ল্যাবে প্রতিনি সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ নমুনা পরীক্ষার কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নতুন করে আজ বুধবার থেকে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়েও নমুনা পরীক্ষার কাজ শুরু করা হবে। তবে এতে কত সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা যাবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন তাদের একটি মেশিনে ৯৬টি করে নমুনা পরীক্ষা করা যাবে। তবে ল্যাবটিতে সর্বোচ্চ ৫শ নমুনা পরীক্ষার ক্ষমতা থাকলেও জনবল না থাকায় তাতেও সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের (সিভাসু) প্যাথলজি এন্ড প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জুনায়েদ ছিদ্দিকী পূর্বকোণকে বলেন, ‘বর্তমানে ল্যাবগুলোতে জনবলের সংকট প্রকট। টেকনিশিয়ান না থাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে নমুনা পরীক্ষার কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এরপরও দিনেদিনে ফলাফল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরমধ্যে যদি নতুন করে নমুনা সংগ্রহ আরও বাড়ে, তাহলে পরীক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই নমুনা সংগ্রহের চেয়ে এ মুহূর্তে বেশি জরুরি জনবল ও ল্যাব সম্প্রসারণ’।
এদিকে, বিদ্যমান তিনটিসহ মোট চারটি ল্যাবে বিদ্যমান জনবল নিয়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬’শ নমুনা পরীক্ষা কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বলেও জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগরসহ জেলা ও তিন পার্বত্য জেলা এবং বিভাগের অন্য জেলা থেকে প্রতিদিন বিদ্যমান তিনটি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় প্রায় হাজার খানেক। আর এরমধ্যে নতুন করে ১৯টি বুথে আরও কমপেক্ষ ৫শ’ অধিক নমুনা সংগ্রহ করা হলে নমুনা পরীক্ষার জট তীব্র আকারে বৃদ্ধি পাবে। এতে করে পরীক্ষা করতে গিয়ে এদিকে যেমন ল্যাব সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হবে, অন্যদিকে ফলাফল দেরিতে পাওয়ার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে এ সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে অভিমত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, বুথ বসানোর আগে আরও দ্বিগুণ ল্যাব স্থাপন করা জরুরি। একই সাথে পরীক্ষা জন্য পিসিআর মেশিন ও কিট সরবরাহের পাশাপাশি জনবল বাড়ানো পরামর্শ তাদের।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির আহবায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান এ প্রসঙ্গে পূর্বকোণকে বলেন, ‘যারা নমুনা সংগ্রহের জন্য বুথ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে এটা অবশ্যই প্রসংশনীয়। তবে প্রথমে জরুরি এসব নমুনা পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি এবং জনবল। জনবল আর পরীক্ষার জন্য যদি ল্যাব যদি বৃদ্ধি না পায়, তাহলে জটের পাশাপাশি সংক্রমণও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। একই সাথে ফলাফলেও ভুল আসবে। তাই কমপক্ষে আরও ১০টি পিসিআর মেশিন বসানোর উদ্যেগ গ্রহণ করতে হবে। যতবেশি মেশিন ও ল্যাব স্থাপন করা যাবে, ততই সংক্রমণ কম ছড়াবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ল্যাব স্থাপন হলে দিনের ফলাফল দিনে পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, বেসরকারি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারগুলোতেও নমুনা পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ এ প্রবীণ চিকিৎসকের।’
অন্যদিকে, নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে কিছু বিধি আরোপ করা হবে জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি পূর্বকোণকে বলেন, ‘চাইলেও যে কারও নমুনা সংগ্রহ করা হবে না। ইতোপূর্বে যেসকল নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তার একটি পরিসংখ্যানে পজেটিভের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি নেগেটিভ ফলাফল আসছে। তাই প্রতিটি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সরাসরি কোন নমুনা সংগ্রহ করা হবে না। এক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে প্রাধান্য দেওয়া হবে। এছাড়া ল্যাব বৃদ্ধি করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সিদ্ধান্ত আসে নি। আসলেও জনবলের যে তীব্র সংকট, তা করা খুবই কঠিন। তবুও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।’

পূর্বকোণ/আরআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট