চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কোভিডে মৃত ৭০ লাশ দাফন
কোভিডে মৃত ৭০ লাশ দাফন

কোভিডে মৃত ৭০ লাশ দাফন

মধ্যরাতে করোনার মৃতদেহ নিয়ে ছুটে আল মানাহিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

৩১ মে, ২০২০ | ১:০২ অপরাহ্ণ

দেড়মাস ধরে বাড়িতে যায় না ওরা। দেখেনি স্বজনদের  চেহারা। করোনা ভাইরাসে  আক্রান্ত-নিহত মানুষগুলো যেন ওদের এক একজন স্বজন। মধ্যরাতে যখন পুরো নগরী ঘুমে আচ্ছন্ন ওরা তখন করোনায়  নিহত মানবদেহ নিয়ে ছুটে কবরস্থানে। ঈদের দিন সবাই পরিবার পরিজনের কাছে ছিল তখন ওরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ছয়জনের মৃতদেহ দাফনে ব্যস্ত ছিল। গত দেড়মাসে চট্টগ্রামে ৭০টির বেশি মরদেহ দাফন ও সৎকার করেছে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। 

এদের মধ্যে ৬০ জনের বেশি মারা যান করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। অন্যরা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় স্বজনরা তাদের দাফন ও সৎকারে অপারগতা জানায়। ফলে  সে দায়িত্বও স্বেচ্ছায় কাঁধে নেয় সংগঠনটি। শুধু করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের দাফন কিংবা রোগী বহন নয়। হালিশহরে একশো শয্যার একটি কোভিড হাসপাতাল চালু করতে যাচ্ছে সেবা মুলক এ সংগঠনটি। নগর পুলিশ কমিশনার  গতকাল শনিবার (৩০ মে) এ হাসপাতালের উদ্বোধন করেন।

আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন দেড়মাস আগে অনেকটা স্বেচ্ছায় কাজটি শুরু করেছিল। এখন চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত সব রোগীর দাফন-কাফন কিংবা সৎকারের কাজটি এসে পড়েছে এই সংগঠনের ঘাঁড়ে। সংগঠনটির ৪০ জন কর্মী পালা করে এই কাজ করে চলেছেন। আশার কথা হলো, এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ সংগঠনের একজন কর্মীরও করোনা পজিটিভ হয়নি।  

চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন  পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেছেন, আমরা এ সংগঠনের কাছ থেকে অসাধারণ সহযোগিতা পাচ্ছি। আমরা তাদের কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। দেখা যায়, কোভিড আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে নিকট আত্মীয়ও তাদের ত্যাগ করেন। কিন্তু সেখানেই নিঃসংকোচে হাজির হন আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

জানা যায়, এই কার্যক্রমে অংশ নেওয়া আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের কোনো কর্মকর্তা কিংবা কর্মী গত দেড়মাসে নিজ বাড়ি যাননি। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নগরীর মোটেল সৈকতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। পুরো একটি ফ্লোরে কর্মীরা এক কক্ষে একজন করে থাকেন।  সেখানে অবস্থান করে তাঁরা পালা করে কাজ করেন। বর্তমানে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স ও দুইটি মাইক্রোবাসে করে দিনে গড়ে ৪০ জন করোনা রোগী এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে আনা নেওয়া করা, করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও তা নির্দিষ্ট ল্যাবে দিয়ে আসা এবং মরদেহগুলো উদ্ধার করে দাফন কিংবা সৎকার কাজে ব্যস্ত থাকছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। অনেকটা প্রচারবিমুখ থেকেই কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা। সর্বশেষ ঈদুল ফিতরের দিন করোনা আক্রান্ত হয়ে ও করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া সাতজন এবং পরদিন ছয়জনের মরদেহও প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা দাফনের ব্যবস্থা করে। আর এভাবেই কেটে যায় তাদের ঈদের দিন।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন জমির উদ্দিন বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর একজন লোককে হাসপাতাল থেকে নিয়ে কবরস্থান কিংবা স্মশানে দাফন করা একটা বড় কর্মযজ্ঞ। এখানে প্রতিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়। দাফন শেষে পিপিই পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তিনি বলেন, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষটি মুহূর্তের মধ্যেই সবার পর হয়ে যান। অথচ এক মুহূর্ত আগেও তিনিই ছিলেন বাড়ির একমাত্র অর্থের যোগানদাতা। পরিবার পরিজনদের ত্যাগ করা ওই লোকটির কাছে তখন আমরা পরিবারের সদস্য হয়ে হাজির হই। এটা আমাদের বাবা মায়ের শিক্ষা।

তিনি বলেন, বর্তমানে তিনটি এম্বুলেন্স ও দুইটি মাইক্রোবাস নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। আগামী দুইদিনের মধ্যে আরো দুইটি এম্বুলেন্স ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি গাড়ির পেছনে মাসে গড়ে একলাখ টাকা খরচ হয়।  

 যেভাবে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু:

আল্লামা জমির উদ্দিন নানুপরী ফটিকছড়িতে আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০১১ সালে মারা যান। তাঁর সাত ছেলে একসঙ্গে বসবাস করেন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন জমির উদ্দিন বলেন, আমার মায়ের বসয় ৮৫ বছর। মূলত মায়ের নির্দেশেই আমরা এই কাজে নেমেছি। কেউ  কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল ও পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়। এরপর শুরু হয় আমাদের কার্যক্রম। তিনি বলেন, রোগি মারা যাওয়ার পর কেউ আর তার পাশে যান না। ফলে অক্সিজেন খোলা থেকে শুরু করে দাফন ও গাড়িতে তোলা এবং সবশেষে জানাজার নামাজ পড়াসহ যাবতীয় কাজ আমরাই করে থাকি। আমার ভাই আল্লামা ফরিদ উদ্দিন জানাজার নামাজে ইমামতি করেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও মারা গেছেন। তাদের নিজ নিজ ধর্মমতে সৎকারের কাজ আমরা করেছি।  

আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের মাঠ পর্যায়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি জানান, হাসপাতালে একজন রোগী মারা যাওয়ার পর যেভাবে চিকিৎসকরা তাদের ছেড়ে চলে যান, মৃতদেহের মুখে  লাগানো অক্সিজেনের মাক্স খোলা থেকে  দাফন সবই তারা করেন।  এ সময় পাশের চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই রোগী  মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অনেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্ট্রোক করেন এবং পরে মারা যান। আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাই নতুন রোগীদের প্রাথমিক পর্যায়ে সাহস দেওয়া হয়।  

বর্তমানে প্রতিদিন চট্টগ্রামে গড়ে একশত জনের বেশি কোভিড-১৯ আক্রান্ত শনাক্ত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে সংক্রমনের সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা মাত্র ৪২০টি। এ অবস্থায় আল মানাহিল ফাউন্ডেশন নগরীর হালিশহরে একটি ১০০ শয্যার কোভিড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজটিও সেরে ফেলেছেন। ইতিমধ্যে ৫০ শয্যার কাজ শেষ হয়েছে। গতকাল শনিবার (৩০ মে)  সিএমপি  কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান ওই হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সেখানে রোগি ভর্তির কাজ শুরু হবে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।

পূর্বকোন/ নাজিম- এএ 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট