চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ক্ষতিপূরণ মাশুলে নাজুক শিপিং সেক্টর

সারোয়ার আহমদ

২২ মে, ২০২০ | ৬:৫১ অপরাহ্ণ

শিপিং অধিদপ্তর গত রবিবার আমদানি-রপ্তানি সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে কন্টেইনারের ক্ষতিপূরণ মাশুল আদায় না করার জন্য আদেশ জারি করেন। শুধু তাই নয়, গত ২৬ মার্চ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত যেসব আমদানিকারক শিপিং এজেন্টকে ক্ষতিপূরণ মাশুল দিয়ে পণ্য খালাস করেছে তাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশনাও দেন। কিন্তু তারপরেও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ শিপিং এজেন্ট পণ্য খালাসের ডেলিভারি অর্ডার দিতে কন্টেইনারের ক্ষতিপূরণ মাশুল আদায় করছে।
এদিকে, শিপিং অধিদপ্তরের নির্দেশনা কার্যকর করতে শিপিং অধিদপ্তরের ডিজি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে বন্দর ও কাস্টমসের ক্ষমতা বাড়াতে সুপারিশ করেছেন। যাতে বন্দর কাস্টমস ওইসব ক্ষতিপূরণ মাশুল আদায়কারী শিপিং এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
অন্যদিকে, এরইমধ্যে দেশীয় শিপিং এজেন্টগুলো গত দুই মাসের অর্থাৎ মার্চ ও এপ্রিলের বাণিজিক লেনদেন তাদের প্রিন্সিপাল বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোর সাথে চুকিয়ে নিয়েছেন। মার্চ ও এপ্রিলে আমাদানিকারকদের ডেলিভারিতে ডেমারেজ চার্জ আদায় করে পণ্য খালাস বিষয়ক সরকারি রাজস্ব জমা দিয়ে দিয়েছে। তাই ঠিক কিভাবে আমদানিকারকদের মার্চ ও এপ্রিলের ক্ষতিপূরণ মাশুল ফেরত নেবেন এবং আমদানিকারদের বুঝিয়ে দেবেন এই নিয়ে দিশেহারা শিপিং কোম্পানিগুলো। বর্তমানে ক্ষতিপূরণ মাশুল বিষয়টি পুরো শিপিং সেক্টরে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেছে।
এ বিষয়ে আমদানিকারকরা বলছেন, সরকারি সিদ্ধান্ত মানছেনা দেশীয় শিপিং এজেন্টগুলো। একতরফাভাবে তারা কন্টেইনারের ক্ষতিপূরণ মাশুল আদায় করে চলেছে। অনেকেই আমদানি পণ্যের মূল্যের চেয়ে কন্টেইনারের ক্ষতিপূরণ মাশুল বেশি হয়ে যাওয়ায় বন্দর থেকে পণ্য খালাস করছেন না। শিপিং এজেন্টদের উচিত সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা। তারা সেটি না করে ডিজি শিপিং এর নির্দেশনা না মেনে এখনো ক্ষতিপূরণ মাশুল আদায়পূর্বক ডেলিভারি অর্ডার দিচ্ছে।
অনেকটা বাধ্য হয়ে পণ্য ডেলিভারি নিতে এখনো ক্ষতিপূরণ চার্জ দিয়ে ডেলিভারি অর্ডার নিতে হচ্ছে মন্তব্য করে সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু পূর্বকোণকে বলেন, শিপিং অধিদপ্তরের আদেশ সরকারি আদেশ। এটি শিপিং এজেন্টদের মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তারা এখনো ক্ষতিপূরণ মাশুল ছাড়া ডেলিভারি অর্ডার দিচ্ছেন না। আর আমদানিকারদেরও পণ্য খালাস করা জরুরি। কারণ কাঁচামাল বা পণ্য না পেলে কারখানাগুলো অচল হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে উচ্চ হারে ক্ষতিপূরণ মাশুল দিয়ে ডেলিভারি অর্ডার নিয়ে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে।
মাশুল আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, কয়েকটি শিপিং এজেন্ট ছাড়া প্রায় সবাই এখনো কন্টেইনারের ক্ষতিপূরণ মাশুল আদায় করছে। কারণ সরকারি আদেশ শিপিং এজেন্টের প্রিন্সিপাল কোম্পানিকে বার বার জানানোর পরে এখনো তাদের কোন নির্দেশনা না আসায় ক্ষতিপূরণ চার্জ আদায় করতে বাধ্য হচ্ছে শিপিং এজেন্টগুলো। তিনি আরো বলেন, সবচেয়ে জটিলতা হলো যে চার্জ ইতিমধ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে আদায় করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং গত মার্চ ও এপ্রিলের হিসেব নিকেশ শিপিং এজেন্টরা তাদের বিদেশি শিপিং প্রিন্সিপাল কোম্পানির সাথে চুকিয়ে ফেলেছেন। সেই চার্জ পুনরায় কিভাবে ফেরত আনা যাবে তা এখনও ঠিক হয়নি। কারণ অনেকগুলো ধাপের মাধ্যেমে সেই কাজ শেষ হয়েছে। সরকারি কোষাগারে আদায় করা ক্ষতিপূরণ মাশুলের রাজস্বও জমা দেওয়া হয়ে গেছে। তাই ঠিক কিভাবে এই টাকা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে ফেরত নেওয়া যাবে এবং আমদানিকারদের ফেরত দেওয়া যাবে তা নিয়ে এখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েই গেছে। যে টাকা বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে, তা ফেরত আনা কত জটিল সেটি শিপিং অধিদপ্তরের বিবেচনা করা উচিত ছিল।
তিনি আরো বলেন, ডিজি শিপিং এর সিদ্ধান্তটি যদি বৈঠকের তারিখ অর্থাৎ ১৭ মে থেকেও কার্যকর করার জন্য বলা হতো তবে বিষয়টি অনেকটা সহজ হতো।
এদিকে গত বুধবার নৌপরিবহন অধিদপ্তর মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম নৌ সচিবকে এক চিঠি পাঠিয়ে বন্দর ও কাস্টমসের ক্ষমতা বাড়াতে সুপারিশ করেন। যাতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নির্দেশনা বন্দর-কাস্টমস কার্যকর করতে পারে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন আমদানিকারক ও চেম্বার অভিযোগ করছে, শিপিং কোম্পানিগুলো ও তাদের এজেন্ট নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সার্কুলার বাস্তবায়ন না করার ফলে অত্যধিক ক্ষতিপূরণ চার্জ পরিশোধে ব্যার্থ হয়ে আমদানিকারকরা মালামাল ডেলিভারি নিতে অপারগ হয়ে পড়েছে। ফলে সরকার বর্তমানে রফতানিমুখি গামেন্টস ও অন্যান্য কলকারখানা চালুর অনুমতি প্রদান করলেও উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার জট বেঁধে বন্দর অচল হওয়ার উপক্রম হচ্ছে, দেশের সরবরাহ ব্যবস্থা ও অর্থনীতি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
তাই দেশের সরবরাহ ব্যবস্থা, অর্থনীতি এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল রাখার স্বার্থে শিপিং কোম্পানিগুলো ও তাদের এজেন্টদের নৌপরিবহন অধিদপ্তর কর্তৃক জারিকৃত ‘এডভাইসরি অন নট টু ইমপোজ কন্টেইনার ডিটেনশন চার্জ অন ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট শিপমেন্ট’ শীর্ষক সাকুলারের প্রতিপালন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিপিং এজেন্টদের লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার করার সুপারিশ করা হলো এবং এমন ক্ষমতার ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে মর্মে প্রতীয়মান।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর আইনের ধারা মোতাবেক চট্টগ্রাম বন্দর জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি কন্টেইনার/ কনসাইনমেন্ট ডেলিভারি প্রদান করতে পারে। বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিপিং এজেন্টসমূহ ক্ষতিপূরণ চার্জ অব্যাহতি প্রদান না করলে চট্টগ্রাম বন্দর সরাসরি তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করতে পারে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে তালিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে যে সকল শিপিং এজেন্ট ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং এর প্রদত্ত নির্দেশনা অমান্য করবে তাদের লাইসেন্স বাতিলের জন্য এনবিআর চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা যেতে পারে।
সরকারি এমন সিদ্ধান্তে এবং বিদেশি শিপিং কোম্পানির প্রিন্সিপাল থেকে আশানুরূপ ফলাফল না আশায় অনেকটা গ্যাঁড়াকলে পড়েছে দেশীয় শিপিং এজেন্টগুলো।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট