চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামের স্বজন, পূর্বকোণের আপনজন আনিসুজ্জামান

আবুল মোমেন

১৫ মে, ২০২০ | ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ

এখনও মনে পড়ছে ১৯৮৩ সনের শেষ দিকে কোনো এক ছুটির দিনে আনিস স্যারের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়াটারে একটি নতুন পত্রিকার নাম নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। সঙ্গে কবি শিশির দত্ত ছিলেন। আর কেউ ছিলেন কিনা এতদিন পরে মনে পড়ছে না। আমরা গিয়েছিলাম একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার নাম নির্বাচনের জন্যে। আমাদের হাতে কয়েকটি বিকল্প নাম ছিল। তিনি সেগুলো দেখলেন কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে বললেন পূর্বকোণ নাম রাখলে কেমন হয়। আমরা নামটা লিখে নিলাম, এভাবেই সিগনেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী মরহুম ইউসুফ চৌধুরী এবং আমাদের স্বপ্নের আধুনিক কাগজের নামকরণ হয়ে গেল। সেই সূত্র ধরে ১৯৮৬ সনে ফ্রেবুয়ারি থেকে দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত হতে শুরু করল।
আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে বাবার সূত্রে আমাদের যোগাযোগ আগেও ছিল। তাছাড়া ১৯৬৯ সনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর থেকে নানা সংগঠন ও কাজের সূত্রে এই যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মনে পড়ছে প্রথম সাংগঠনিক যোগাযোগ হয় চট্টগ্রাম সিভিল সোসাইটির সভাপতি পদে তাঁকে নির্বাচনের মাধ্যমে। সেই থেকে অনেক সংগঠন ও অনুষ্ঠানের পরিচালনা ও আয়োজনে তাঁকে সভাপতি করে আমি সম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছি। সেই যোগাযোগ আরও গভীর হয় ১৯৭৮ সনে যখন তাঁকে আমরা শিশুপ্রতিষ্ঠান ফুলকির সভাপতি হিসেবে পেয়েছিলাম। ১৯৮৬ সনে তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরে এই যোগাযোগ কিন্তু ছিন্ন হয়নি। শিক্ষা এবং সংস্কৃতির কাজ চালানোর জন্যে আমরা গঠন করেছিলাম দুই কৃতী বাঙালি শিক্ষাবিদ বিদ্যাসাগর ও বেগম রোকেয়ার নামে ‘বিদ্যাসাগর-রোকেয়া শিক্ষা ট্রাস্ট’। আমৃত্যু তিনি এটির সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক। কখনও ঢাকায় তাঁর বাসায় কখনও বা চট্টগ্রামে তিনি যে গেস্ট হাউসে উঠতেন সেখানে আমরা সাংগঠনিক সভায় মিলিত হয়েছি। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বৃহস্পতিবার বিকেলে আমাদের ছেড়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে বহুমানুষ ব্যক্তিগতভাবে এতই প্রাণবন্ত সম্পর্কে যুক্ত ছিলেন যে, তিনি তাঁদের স্মৃতিতে অম্লান থাকবেন। এমন মানুষ সারা বাংলাদেশে বিস্তর ছড়িয়ে আছেন। তাঁদের কেউবা বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি আবার অনেকেই হয়ত সাধারণ সংসারী ছাপোষা মানুষ। তিনি নিজে একজন কৃতী ব্যক্তি যিনি বহু সম্মান ও স্বীকৃত হলেও কখনও নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন হতে দেন নি। তাঁর কাছে সহজেই যাওয়া যেত, যে কোনো কথা খুলে বলা সম্ভব হতো এবং নানারকম ব্যক্তিগত প্রত্যাশা পূরণের আবদারও করা যেত। তিনি সাধ্যমত সকলকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতেন। তবে সেইসাথে একথাও বলতে হবে ড. আনিসুজ্জামান চেতনা ও বিশ্বাসে একজন বাঙালি ছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানুষ ছিলেন, বিশ্বচেতনার আধুনিক মানুষ ছিলেন এবং তাঁর অবস্থানে তিনি স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেকারণে বিরোধী মতের মানুষের সঙ্গে কখনও বৈরিতায় জড়াননি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল ¯িœগ্ধ এবং তা প্রসন্নতায় ইতিবাচক থাকত। তাঁর সম্পর্কে বলা যায় তিনি একজন দৃঢ়মনের ইতিবাচক মানুষ ছিলেন। সমাজে যখন অবক্ষয় এবং নীতিবাচকতার চর্চা বাড়ছে তখনও তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরেন নি। ইদানিং মাঝে মাঝে তাঁর কথায় হতাশার সুর শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আশাবাদী ভবিষ্যতমুখী একজন মানুষ।
প্রফেসর আনিসুজ্জামান ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সন পর্যন্ত ১৬ বছর চট্টগ্রামে কাটিয়ে গেছেন। এসময় তিনি চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক অঙ্গন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের সাথে নানাকাজে জড়িত হয়েছিলেন। সেদিক থেকে তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামের মানুষও এক স্বজন হারানো বিয়োগ ব্যথায় কাতর হবে। আর দৈনিক পূর্বকোণ হারালো তাঁর একজন বিশিষ্ট শুভানুধ্যায়ীকে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট