চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

লেবু চাষিদের সুদিন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৫ মে, ২০২০ | ৬:০৮ অপরাহ্ণ

রমজানে ইফতারে লেবুর শরবতের কোনো জুড়ি নেই। ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্ত সবার ইফতারির টেবিলে লেবুর শরবত শোভা পায়। এই রোজায় সুদিন যাচ্ছে লেবু চাষিদের। তবে গত কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ায় লেবুর দাম হঠাৎ করে প্রায় তিন গুন কমে গেছে। অর্থাৎ চাষিরা যে লেবু সাড়ে ১০ টাকায় বিক্রি করেছেন, তা এখন বিক্রি করছেন আড়াই থেকে তিন টাকা।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া ও চন্দনাইশে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক লেবুর চাষ হয়। চন্দনাইশের বাতাবি লেবুর কদর রয়েছে দেশজুড়ে। তবে বর্তমানে বোয়ালখালীর পাহাড়ি এলাকায় ব্যাপক হারে লেবুর চাষ হয়।
গতকাল সোমবার বোয়ালখালীর বিভিন্ন আড়তে প্রতি ভার (৩০০ লেবু) বিক্রি হয়েছে আকার ভেদে ৮শ থেকে এক হাজার টাকা। সেই লেবু চট্টগ্রাম শহরে বিক্রি হচ্ছে জোড়া ২০ টাকা দরে। ছোট আকারের লেবু ১০-১৫ টাকা দরে। চন্দনাইশ ও পটিয়ার লেবু চাষিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। চন্দনাইশেও জোড়া বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ টাকা দরে। মধ্যস্বত্বভোগী ও ফড়িয়া ব্যবসায়ী চাষিদের ভাগ্য লুটে নিচ্ছেন।
কৃষিতে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত (প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার) লেবু চাষি মোজাম্মেল হক বকুল বলেন, গত এক মাস ধরে প্রতি ভার (৩০০টি) ৩২’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। রোজার প্রথমদিনেও বোয়ালখালীর বিভিন্ন আড়তে তিন হাজার থেকে ৩২ টাকা দরে লেবু বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার পর থেকে সেই দর দিনে দিনে অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। গতকাল আড়তদাররা আকারভেদে ৮শ থেকে এক হাজার টাকা দর দিয়েছে লেবু চাষিদের।
জানা যায়, বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরা, আমুচিয়া ও কড়লডেঙ্গা পাহাড়ি এলাজাজুড়ে তিন হাজারেরও বেশি লেবু বাগান রয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ ট্রাক লেবু চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।
জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকার মোজাম্মেল হক বকুলের ছোট-বড় মিলে ৮টি লেবু বাগান রয়েছে। সবমিলে হাজারখানেক বাগান রয়েছে বলে জানান বকুল। তিনি বলেন, এসব বাগানকে ঘিরে ৫-৬টি লেবুর আড়ত রয়েছে। আমুচিয়া ও কড়লডেঙ্গায় রয়েছে অন্তত আরও দুই হাজারের বেশি লেবু বাগান। কড়লডেঙ্গা মাজার গেট ও আমুচিয়ার নয়াহাট এলাকায় রয়েছে আরও অন্তত ১০-১৫টি আড়ত। সবমিলে দৈনিক দুই কোটি টাকার লেবু যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়।
লেবু চাষি, আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বোয়ালখালী থেকে আড়তদারের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় কাঁচা বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫ ট্রাক লেবু যায় বোয়ালখালী থেকে। আর ঢাকার শ্যামবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফেনীতেও কয়েক ট্রাক লেবু পাঠানো হয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব লেবু দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। কয়েকটি জেলায় সরাসরি ট্রাকে করে লেবু পাঠানো হয়।
পটিয়ার পাহাড়ি এলাকা শ্রীমাই, খরনা, হাইদগাঁওয়ে বিপুল পরিমাণে লেবুর চাষ করা হয়। লেবু চাষিরা জানায়, স্থানীয়ভাবে আড়ত না থাকায় উপজেলার বিভিন্ন বাজারে লেবু বিক্রি করেন চাষিরা। এসব বাজার থেকে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা লেবু কিনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করে।
চন্দনাইশের কাঞ্চনগর, হাসিমপুর, লর্ড এলাহাবাদ, সৈয়দাবাদ, দোহাজারীর লালুটিয়া, ধোপাছড়ির পাহাড়ি এলাকায় বিপুল পরিমাণে লেবুর চাষাবাদ হয়। চন্দনাইশের কাগজী লেবুর সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। কাগজী জাতের লেবু আকারে বড় ও সুঘ্রাণ রয়েছে। তাই মানুষের কাছে কাগজী লেবুর কদর বেশি। লেবু চাষিরা জানায়, এখানকার উৎপাদিত লেবু শহরের বিভিন্ন আড়তের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দিনে প্রায় ২৫ লাখ টাকার লেবু দেশের বিভিন্ন স্থানে যায় চন্দনাইশ থেকে। চন্দনাইশের রৌশন হাট, বাদামতল, খানহাট, বাগিচা হাটসহ বিভিন্ন বাজারে লেবু বিক্রি করে চাষিরা।
লেবু চাষিরা জানায়, গ্রীষ্মকালে লেবুর দাম ভালো পাওয়া যায়। গ্রীষ্মের গরমে লেবুর শরবতের কদর বেশি থাকে। এছাড়াও খাবারেও লেবুর ব্যবহার বেশি হয়। সব মানুষের কাছে লেবুর কদর থাকায় দামও ভালো পায় চাষিরা। গত একমাস ধরে ভালো দাম পেয়ে আসছেন চাষিরা। কিন্তু এখন বৃষ্টি বাগড়া দিয়েছে লেবুর দরে। তবে চলতি বছর রোজার মাস হওয়ার কারণে ভালো দাম পেয়ে আসছে লেবু চাষিরা।
কৃষি বিভাগ জানায়, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও পটিয়া জুড়ে পাহাড়ি এলাকায় লেবুর ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে। করোনা পরিস্থিতিতে লেবু চাষিদের জন্য সুদিন যাচ্ছে। লেবুর ভালো দাম পাচ্ছে। বেড়ে ৩ গুন হয়েছে। যে লেবু ৫ টাকা ছিল, বর্তমানে বাজারে সে লেবু ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কড়লডেঙ্গা পাহাড়ি এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পানি ও সার দেওয়ায় গাছে গাছে প্রচুর লেবু ধরেছে। করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের মজুরিও বেশি। আর পাম্পের মাধ্যমে লেবু গাছে পানি দিতে প্রচুর খরচ হয়। আড়তে নিয়ে যেতে পরিবহনের খরচও বেড়েছে। তারপরও বাজারে লেবুর চাহিদা বেশি। ক্রেতাদের কাছে পাহাড়ি লেবু বেশ জনপ্রিয় বলে দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে।
নগরীর বিভিন্ন বাজারে রোজার প্রথমদিনে এক জোড়া লেবু ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এখন তা ২০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। বৃষ্টির কারণে দাম কমে গেছে বলে জানায় ব্যবসায়ীরা। তবে বৃষ্টির পানিতে লেবুর চাষও ভালো হয়। কারণ পানি না পেলে লেবু হৃষ্টপুষ্ট হয় না। সেচের মাধ্যমে পানি দিতে হয়। পাহাড়ি এলাকায় সেচের পানিতে খরচ বেশি পড়ে।
চিকিৎসকরা জানান, এ সময়ে লেবু খাওয়া ভালো। লেবুর রস মিশ্রিত পানি পানীয় হিসেবে খুবই উপকারী। কেবল স্বাদে নয়, গুনেও। লেবুর রস মিশ্রিত পানি পাকস্থলী ও অন্ত্রের অন্যান্য অংশ থেকে পাকরস তৈরি ত্বরান্বিত করে। ভারী খাবারের সঙ্গে লেবুপানি পান করলে গ্যাস কম হবে, পেট ফাঁপবে কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, পাহাড়ে চাষিরা আগ্রহের সঙ্গে ব্যাপকভাবে লেবু চাষ করছেন। বৃষ্টি শুরু হলে গাছে লেবুর উৎপাদন বাড়বে। দামও কমে যাবে। উৎপাদন কম হওয়ায় বর্তমানে লেবুর দাম বেড়েছে। তবে লেবু চাষিদের বিষয়ে কোন তথ্য নেই কৃষি বিভাগে।
লেবু চাষি রহমান মিয়া জানান, লেবুর চারা একবার রোপণ করলে তিন বছর পর ফল পাওয়া যায়। একটি লেবু গাছ কয়েক বছর ফল দেয়। লাভজনক ব্যবসা বলে অনেকেই লেবু চাষে ঝুঁকে পড়েছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট