চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

বর্ষণে বাড়ছে পাহাড় ধস আতঙ্ক

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৪ মে, ২০২০ | ৯:২৬ অপরাহ্ণ

ভারী বর্ষণে নগরজীবনে ভর করে দুই ধরনের আতঙ্ক। জলাবদ্ধতা ও পাহাড় ধস। এই দুটি কারণে নগরীতে ঘটে আসছে প্রাণহানি ও সম্পদহানি। গতকাল সকালে নগরীতে ভারী বর্ষণে নিচু এলাকাসমূহ পানিতে ডুবে যায়। মেগা প্রকল্পের কাজে প্রধান খালগুলোতে বাঁধের কারণে পানি নিষ্কাশনে বিঘ্ন ঘটছে। বৃষ্টির পানিও দ্রুত নামতে পারছে না। এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের দরুণ আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বিশেষ করে পাহাড় ধসের আতংক ভর করেছে জনমনে।
বর্ষা আসলেই পাহাড় ধস আতঙ্কে দিন কাটাতে হয় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের। চলতি মৌসুমেও ঝড়ো হাওয়া আর ভারী বৃষ্টিতে বেড়েছে পাহাড় ধস আতঙ্ক।
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ বা সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু করে প্রশাসন। এবার বর্ষার আগেভাগেই উচ্ছেদ পরিকল্পনা নিয়েছিল জেলা প্রশাসন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ এক মাসের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২০তম সভার এই সিদ্ধান্ত ছিল। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের উপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওইদিন মন্ত্রী মতিঝর্ণা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী এলাকা পরিদর্শনও করেছিলেন।
সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান। সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এ বি এম আজাদ। উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেবাধর্মী বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থার প্রতিনিধিরা।
মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেছিলেন, ‘পাহাড় পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাউকে আমরা রাখতে পারি না। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বৈধ-অবৈধ সকলকে উচ্ছেদ করা হবে। কারণ পাহাড় ধসে মানুষ মারা গেলে দায়-দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে। তাই পাহাড় মালিকেরা নিজ উদ্যোগে তালিকা করে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সরকার সব ধরনের সহায়তা করবে।
এক মাসের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত থাকলেও কোনো সংস্থাই মন্ত্রীর নির্দেশনা মানেনি। ফলে প্রতিবছরের ন্যায় এবার বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড় ধস আতঙ্ক।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। টানা বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মানুষগুলো ঝুঁকিতে পড়বে’।
প্রতিবছর বর্ষা আসলেই পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদে তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই এগোয়নি। পাহাড় মালিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কারণে উচ্ছেদ পরিকল্পনা বার বার ভেস্তে গেছে। কিন্তু এর নেপথ্যে রয়েছে আরেক রাজনীতি। অবৈধ দখল বাণিজ্য ও পাহাড়খেকোদের রাজনীতিতে পরাস্ত হচ্ছে প্রশাসন। প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে শুরু হয় রাজনীতি। উচ্ছেদ ঠেকাতে রাস্তায় নেমে পড়েন অবৈধ বসবাসকারীরা। নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা। গত বছর মতিঝর্ণা এলাকায় উচ্ছেদ কার্যক্রম ঠেকাতে সড়ক অবরোধ করেছিল অবৈধ বসবাসকারীরা। তাদের পক্ষে রাস্তায় নেমেছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম ও মহিলা কাউন্সিলর বিএনপি নেত্রী মনোয়ারা বেগম মনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের মধ্যে অধিকাংশই নি¤œআয়ের মানুষ। রিক্শা-ভ্যানচালক থেকে শুরু করে গার্মেন্টসকর্মীর সংখ্যা বেশি। কম টাকায় বাস ভাড়া হওয়ায় এসব পাহাড় পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাস করে আসছে তারা। দখলদারের তালিকায় রয়েছে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও অবৈধ ভূমিদস্যুরা। পাহাড় কেটে অবৈধভাবে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে আসছেন পাহাড়খেকোরা। জমিদারি কায়দায় নেপথ্যে রয়েছে এসব পাহাড়-দস্যুরা।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নগরীর ১৭টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৮৩৫ পরিবারের বসতি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে মতিঝর্ণা ও বাটালিহিল পাহাড়ে। ২০০৭ সালের ১১ জুন মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই থেকে পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যায়নি।
জানা যায়, পাহাড় ধসে অতি ঝুঁকিতে থাকায় সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭ পাহাড় মালিককে নিজ উদ্যোগে অবৈধ বসতি সরিয়ে নিতে চিঠি দিচ্ছেন জেলা প্রশাসন। পাহাড়ধসে জানমালের ক্ষয়ক্ষতিরোধে দ্রুত সময়ে নিজ উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরিয়ে নিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসনের সেই চিঠি আমলে নেয়নি কোনো সংস্থা।
নগরের মতিঝর্ণা পাহাড়ে দেখা যায়, পাহাড় কেটে পাদদেশে ভাঁজে ভাঁজে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে চরম ঝুঁকিতে বসবাস করছে অনেক পরিবার। একই অবস্থা বাটালি হিল পাহাড়েও। আকবর শাহ এলাকা, রৌফাবাদ এলাকা সংলগ্ন মিয়ার পাহাড় কেটে গড়ে ওঠেছে বস্তিঘর। বসবাস করছে শত শত নিম্নআয়ের মানুষ। বৃষ্টিতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
গত বছরের ১৩ জুলাই সকালে আরেফিন নগরের অদূরে জানু বাপের ঘোনা এলাকায় পাহাড় ও কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছিল। পাহাড় ধসে মারা গিয়েছিল ৩ জন।
দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পাদদেশে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ রয়েছে। বিদ্যুতের এক মিটার থেকে ১০-১২টি সংযোগ রয়েছে। পাহাড়খেকোরা বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ দিয়ে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করছে। জেনেও নিশ্চুপ রয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২৮টি পাহাড়ে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে বসবাস করছে ৮৩৫ পরিবার। এরমধ্যে ১৪টি পাহাড় সরকারি ও ১৪টি পাহাড় ব্যক্তি মালিকানাধীন। পাহাড় কাটার ফলে পাহাড় ধসের ঘটনা বাড়ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। এরপর কমিটি গঠন করা হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো নীতিমালা করা হয়নি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট