চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পাইকারি ক্রেতা ও পরিবহন সংকট।

সবজি চাষিদের মাথায় হাত

ক্ষেতের সবজি ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৫ এপ্রিল, ২০২০ | ৬:৪১ অপরাহ্ণ

করোনায় বিপর্যস্ত সবজি চাষিরা। গ্রীম্মকালীন সবজির ভালো উৎপাদন হলেও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় মাথা হাত পড়েছে তাদের। লকডাউনের পর সবজি ভান্ডারখ্যাত সীতাকুণ্ড, চন্দনাইশ, দোহাজারীসহ বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। সাথে রয়েছে পরিবহন সংকট। এতে ক্ষেতের সবজি ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিক্রি করতে হচ্ছে পানির দরে। অথচ নগরীর বিভিন্ন বাজারে সবজি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সীতাকুণ্ড, চন্দনাইশের দোহাজারী রেলওয়ে বাজার, বাঁশখালী, রাঙ্গুনীয়া, আনোয়ারা ও শহরতলী উপজেলা থেকে চট্টগ্রামের সবজির চাহিদা মেটানো হয়। তবে সীতাকুণ্ডের সবজি চট্টগ্রামের চাহিদা অনেকটা পূরণ করে আশপাশের জেলাও সরবরাহ করা হয়। সবজি উৎপাদনকারী প্রতিটি উপজেলায় এখন পাইকারি ব্যবসায়ী কমে গেছে। অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে সবজির দাম। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজি ভান্ডার হিসেবে পরিচিত চন্দনাইশের দোহাজারী শঙ্খ নদী তীরের উৎপাদিত সবজি চাষীদেরও একই অবস্থা। সবজি উৎপাদন ভালো হলেও করোনাভাইরাস সংকটে লকডাউনের পর থেকে অনেকটা ক্রেতা শূন্যতা বিরাজ করছে। এতে পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদিত সবজি। অন্যান্য উপজেলায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তাই উৎপাদিত সবজি বাজারে তোলার বদলে ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সীতাকুণ্ড দোহাজারী বাজারসহ বিভিন্ন সবজি বাজারে কৃষকেরা সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে পানির দরে। টমেটো ২-৩ টাকা, বেগুন ৫-৬ টাকা, তিতকরলা ১৫-২০ টাকা, বরবটি ১৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতিটি (২-৩ কেজি ওজন) ১০-১৫ টাকা, ঢেঁড়স ২০ টাকা। দুর্যোগের মধ্যেও নগরীর বিভিন্ন কাঁচা বাজারে টমেটো বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ২০ টাকা, বেগুন ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ৩০ টাকা, তিতকরলা ও বরবটি ৩০ টাকা করে, কাঁচা মরিচ ৫০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া কেজি ২৫ টাকা করে। সেই হিসাবে দেখা যায় পানির দরে সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে চাষীদের।

সীতাকুণ্ড সংবাদদাতা সৌমিত্র চক্রবর্তী জানান, লকডাউন ঘোষণা করার পর থেকে সবজি ভা-ার খ্যাত সীতাকু-ে সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। দরপতনের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সব ধরনের সবজির দাম আগের তুলনায় অনেক কমে বিক্রি হচ্ছে। সবজি দাম কমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন সবজি চাষিরা। স্থানীয় বাজারের দেখা যায়, গতকাল মঙ্গলবার সীতাকু- মোহন্তেরহাট আগের মতো জমেনি। ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা ছিল অনেক কম। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা না আসায় সবজি বেচাকেনা তেমন হয়নি। আর যা বিক্রি করেছেন একেবারে পানির দরে। কৃষকরা জানান, প্রতি কেজি টমেটো পাইকারি মূল্যে ৩-৫ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। ঢেঁড়স প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ১০-১২ টাকা, বেগুন ৮ টাকা, করলা ১৫-২০ টাকা, বরবটি বিক্রি হয়েছে ১৫-২০ টাকা, ঝিঙ্গা ২০-২৫ টাকা, চিচিঙ্গা ১২-১৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ১০-১২টাকা, কাঁচা মরিচ ৩০-৩৫ টাকা, ধনে পাতা ৭০-৮০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
উপজেলার নুনাছরার কৃষক মো. ইয়াছিন জানান, বাজারে দুই মণ টমেটো নিয়ে এনেছিলেন। আশায় ছিলেন দাম কিছুটা বাড়বে। মাত্র ৩-৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। লকডাউনের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা না আসায় পানির দরে বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মাঝখানে অনেকে টমেটো বিক্রি করতে না পেরে ক্ষেতে ফেলে দিয়েছেন। অনেকেই টমেটো ক্ষেত থেকে না তুলে নষ্ট করে ফেলছেন। তিনি আরো বলেন, এই সময়ে প্রতি কেজি টমেটোর দাম ৪০-৫০ টাকা হওয়ার কথা। রোজায় এসব আরো বেড়ে যাবার কথা। কিন্তু আমরা এখন চরম হতাশ। ক্ষেত থেকে গাড়িতে করে সবজি বাজারে আনতে যে খরচ তাও উঠছে না। সীতাকুণ্ডের বড় পাইকারী আড়ৎ সীতাকু- সবজি ভান্ডারের মালিক সুনীল দাশ জানান, লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই সবজির দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় চাষিরা এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন।

চন্দনাইশ সংবাদাতা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান : দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজি ভান্ডার নামে খ্যাত দোহাজারী শঙ্খ তীরবর্তী এলাকায় প্রচুর সবজির চাষ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকেরা খুশি। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সবজির দাম কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে কৃষকেরা।
উপজেলার শঙ্খ তীরবর্তী দোহাজারী, লালুটিয়া, রায়জোয়ারা, ধোপাছড়ি, বরমা, চরবরমা, বৈলতলী, পাহাড়ী এলাকা লর্ড এলাহাবাদ, সৈয়দাবাদ, কাঞ্চননগরসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সবজির চাষ হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকটের কারণে চট্টগ্রাম মহানগরসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা না আসায় দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন বাজারে কয়েক গুণ বেশি দামে সবজি বিক্রয় হচ্ছে। চন্দনাইশের দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৫-৬ টাকা, টমেটো ২-৩ টাকা, বরবটি ১৫ টাকা, ঢেঁড়শ ২০ টাকা, মূলা ১০ টাকা, তিতকরলা ১৫-২০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া প্রতিটি ১০-১৫ টাকা, কাঁচা মরিচ ১০ টাকা, শিম ১০ টাকা, লাউ প্রতিটি ৬-৭ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। কৃষকেরা তাদের খরচ পুঁষিয়ে লাভের মুখ দেখছে না বলে জানালেন কৃষক মো. সোহেল। দোহাজারী শঙ্খ তীরবর্তী এলাকার কৃষক এমএ ফয়েজ বলেছেন, তিনি ২০ হাজার টাকা করে ৬০ হাজার টাকায় ৩ কানি জমি সবজি চাষের জন্য নিয়েছেন। ইতোমধ্যে বেগুন, টমেটো, বরবটি রোপণ করে ফলন পেতে শুরু করেছেন। কিন্তু দাম কম হওয়ায় খরচ পুষিয়ে লাভের মুখ দেখবে না বলে হতাশা তিনি। একইভাবে করিম ও আলিম এক কানি করে খাজনা দিয়ে সবজি চাষের জন্য জমি নিয়ে বেগুন, মিষ্টি কুমড়া চাষ করে ফলন পেলেও দাম কম হওয়ায় কীটনাশক, সার, শ্রমিক মজুরী, জমির খাজনা পুঁষিয়ে লাভবান না হয়ে লোকসানে পড়েছেন বলে জানালেন।

বাঁশখালী সংবাদদাতা অনুপম কুমার অভি জানান, উপজেলার হাটহাজারগুলোকে করোনোভাইরাস সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে ফসলি জমিতে উৎপাদিত গ্রীষ্মকালীন সবজি হাটবাজারে তুলেও কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। কৃষকদের উৎপাদিত ফসল মাঠেই থেকে যাচ্ছে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ১৭ শ হেক্টর জমিতে ১০ ইউনিয়নের ৮-৯ হাজার কৃষক বৈলছড়ি, কালীপুর, সাধনপুর, পুকুরিয়া, শীলকূপ, চাম্বল, পুইছড়ি, সরল ও বাঁশখালী পৌরসভার জলদীতে কৃষকরা গ্রীষ্মকালীন কাকরোল, চিচিঙ্গা, শসা, ঢেড়শ, করোলা, বরবটি, ঝিঙ্গা চাষ করে থাকেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রমন রোধে সরকারি ভাবে ঘরে থাকা ঘোষণা আসার পর কৃষকদের উৎপাদিত সবজি ফসলগুলো বাজারে তুলেও কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। কালিপুর ইউনিয়নের কৃষক আবদুর রহমান, আবুল কাশেম, মোহাম্মদ হারুন জানান, করোলা অন্যান্য সময়ে ৪০ টাকা দামে কেজি বিক্রি হলেও বর্তমানে ২০/২৫ টাকা দামে কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাঁশখালীতে না আসায় উৎপাদিত সবজির ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। অনেক কৃষক বরবটি, শসা, করোলা, ক্ষেত থেকে তুলতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা সরকারি আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়েছেন।
বাঁশখালী কৃষি কর্মকর্তা আবু সালেক বলেন, বাঁশখালীতে উৎপাদিত গ্রীষ্মকালীন শস্যগুলিতে কৃষকরা সবজিগুলো বাজারে তুলেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। অন্যান্য সময় এর চেয়ে বাজার দর অর্ধেক। তাছাড়া পাইকারী ব্যবসায়ীরাও এলাকা না আসাতে কৃষকদের এই দুর্দশা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট