চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিত্যপণ্যের পিকআপে লুটপাট

খাদ্য লুটে দুশ্চিন্তায় প্রশাসন

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট হবার শঙ্কা

নাজিম মুহাম্মদ

১৯ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

ত্রাণের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছিলো শত শত সিএনজি ট্যাক্সিচালক। এ সময় রাষ্ট্রায়াত্ত তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েলের বহির্নোঙরে থাকা জাহাজের নাবিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে যাচ্ছিলো একটি মিনি পিকআপ। আর পিকআপ ভর্তি বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী লুট করে নেয় অবরোধকারীরা। ওই পিকআপে ছিল- মাছ, গরুর মাংস, চাল, আপেল, মাল্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। গাড়িটি অবরোধকারী শ্রমিকদের সামনে দিয়ে যাবার সময় আটকে দেয় শ্রমিকরা। চালককে নিচে নামিয়ে পণ্যগুলো নিয়ে যায় তারা। এসময় গাড়ির চালকও শ্রমিকদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা জানায়, যারা খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গেছে তাদের অধিকাংশই নি¤œআয়ের মানুষ। যারা গত দুইদিন ধরে খাবারের জন্য সড়ক অবরোধ করে আসছিল। গতকাল শনিবার দুপুর সাড়ে বারোটায় এ ঘটনা ঘটে। সিএনজি ট্যাক্সি চালকদের দাবি ২০ দিনের বেশি সময় ধরে তারা গাড়ি চালায় না। তাদের রোজগার নেই। জমা টাকাও শেষ।
কারো কাছ থেকে ত্রাণও পায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, পিকআপের (চট্টমেট্টো-ন-১১-৪৮৩৩) চালক রবিউল হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, বঙ্গোপসাগরের বহির্নোঙরে থাকা পদ্মা অয়েলের নাবিকদের জন্য এসব খাবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব খাবার পিকআপে পতেঙ্গা পদ্মা অয়েলের ৬ নম্বর ঘাটে নেয়া হচ্ছিলো।
রবিউল বলেন, আগ্রাবাদ থেকে আমার পিকআপে ট্রাফিকের একজন সার্জেন্ট উঠেছিলো। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে বড়পুলে পৌঁছালে সিএনজি চালকদের অবরোধের মুখে পড়ি। ট্রাফিকের সার্জেন্ট বসা দেখে তারা প্রথমে গাড়ি ছেড়ে দেয়। সামনে এগুতেই হঠাৎ একদল শ্রমিক ফের দাঁড় করিয়ে পিকআপে থাকা বিভিন্ন খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী লুট করে। এরমধ্যে ছিল দুই বস্তা চাল, দুই কার্টন আপেল, এক কার্টন মাল্টা, ১৪ কেজি গরুর মাংসের একটি প্যাকেট, দুই বস্তা তরমুজ, দুই কার্টন প্রাণ লিকুইড দুধ, এক কার্টন চাইনিজ বাধাকপি ও লবণ। টানাটানিতে বেশ কিছু খাদসামগ্রীর প্যাকেট ছিড়েও গেছে। ওই সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন। তবে শ্রমিকদের বাধার মুখে পুলিশ কিছুই করতে পারেনি।
হালিশহর থানার পরিদর্শক (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বড়পোল এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালকরা ত্রাণের দাবিতে সড়ক অবরোধ করছিল। এ ধরনের বিষয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করেনি। তবে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক বিষয়টি আমার কাছে জানতে চেয়েছে।
রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা দিনরাত খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করছেন- এমন ছবি হর-হামেশা সামাজিক যোগাযোম মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। তবে নি¤œবিত্ত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষের অভিযোগ, প্রভাবশালী কেউ ফোন করে না দিলে বস্তিবাসী কোনোভাবেই খাদ্যপণ্য পাচ্ছে না। রিকশাচালক, দৈনিক শ্রমিক, কাজের বুয়া পর্যায়ের এসব লোক সামাজিক বিচ্ছিন্নতা শুরুর সময় যে খাদ্যদ্রব্য মজুত করেছিল, তা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। অথচ প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখন খোঁজ নিয়ে নিয়ে মধ্যবিত্তদের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন। ফলে অভুক্ত মানুষের দ্বারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট হবার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, খাদ্য লুটের এই ঘটনা আমাদের সবাইকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কারণ একটা ঘটনা ঘটার পর অন্যরা সেটাকেই অনুসরণ করতে চাইবে। তাই আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি, যারা ত্রাণ দেবে তারা যেন প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতা নেন। আর এভাবে প্রকাশ্যে খাদ্যদ্রব্য বহন থেকে বিরত থাকেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামে প্রায় ৮ লাখ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। পরিবার প্রতি একবার ১০ কেজি করে দিলেও প্রয়োজন ৮ হাজার টন চাল। সিটি কর্পোরেশন পেয়েছে এখন পর্যন্ত ৬০০ টন। অর্থাৎ মোট চাহিদার ১৬ ভাগের এক ভাগ। এ অবস্থায় চসিক একলাখ ১৮ হাজার পরিবারকে ত্রাণ দেওয়ার লক্ষ্যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলরদের তালিকা করতে বলেছে। তবে অভিযোগ এসেছে, ওয়ার্ড কাউন্সিলররা তাদের কাছের লোকজনকেই কেবল তালিকাভুক্ত করছেন। কারণ হলো, যে পরিমাণ অভুক্ত মানুষ আছে, ত্রাণের পরিমাণ তার চেয়ে কম।
তবে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, আমি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের বলেছি, ভোটার না হলেও কেবল ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর দিয়েই তাদের নাম তালিকাভুক্ত করতে হবে। প্রান্তিক প্রতিটি মানুষকে এই তালিকায় আনতে হবে। আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যেই তালিকা তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। তিনি বলেন, তালিকা তৈরির কাজ চলছে, পাশাপাশি খাবার বিতরণও চলছে।
তবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের খাদ্যপণ্য বিতরণের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নেই। ফলে কেউ একাধিকবার পেলেও অনেকে একবারও পাচ্ছে না।
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমরা চসিককে নিয়মিতই চাল দিচ্ছি। এক-দুই দিন পরপর ১০০/২০০ টন চাল দিচ্ছি। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা অনেকে করোনা ভয়ে আছেন। অনেকে হয়তো বুঝতে পারছেন না কীভাবে পদ্ধতি চালু করবেন। তবে আমি মেয়র মহোদয়কে বলেছি, প্রত্যেকের কাছে ত্রাণ পৌঁছতে হবে। চসিকের কাছে এখনো ৩০০ টন চাল আছে। কেউ চাল বিতরণে অনিয়ম করলে শাস্তি পাবেন।
কর্মকর্তাদের এতোসব আশ্বাসের পরও দেখা যায়, অপ্রতুল খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার কারণে নগরীর রাস্তায় নামছে ক্ষুধার্ত মানুষ। ইতোমধ্যে নগরীর সিটি গেইট থেকে শুরু করে বড়পুল পর্যন্ত পোর্ট কানেকটিং রোডে ক্ষুধার্ত মানুষ টানা তিনদিন বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ ও মিছিল সমাবেশ করেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট