চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

করোনা মহামারী

করোনায় অনিশ্চিত ঈদ বাজার

নাজিম মুহাম্মদ

১৩ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

  • ‘ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে মালামাল তুলেছেন দোকানে, বন্ধ থাকায় আমরা দিশেহারা’
  • ‘শোরুমে ৫০ থেকে ১০০ জন করে কর্মচারী, বেতন দিতে হয় মাসে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা’

করোনা মহামারীতে অনিশ্চিত হয়ে গেছে ঈদের বাজার। ভেস্তে গেছে নববর্ষের যত আয়োজন। রমজান শুরুর আগে থেকেই নগরীর পোশাকের বাজারে ক্রেতাদের চাপ সৃষ্টি হয়। বিক্রেতারাও ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে নানা ধরনের পোশাক তোলেন দোকানে। দেশি-বিদেশি সব ধরনের পোশাকের দেখা মিলে ঈদ বাজারে। এবারের ঈদের বাজারের চিত্র ভিন্ন। করোনায় লোকসানের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন আগে কখনও ব্যবসায়ীদের হতে হয়নি বলে জানান তারা। করোনার বিস্তাররোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। যা দুই দফায় বাড়িয়ে আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বাংলাদেশে সকল জমায়েত নিষিদ্ধ করে পহেলা বৈশাখের নববর্ষ ও এ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের এ প্রভাব সারাদেশের মতো নববর্ষের বেচাকেনা শতভাগ থামিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমান সময়ে মানুষ উৎসব কেন্দ্রীক কেনাকাটা করে থাকেন। উৎসবকে কেন্দ্র করে বাহারি ডিজাইনের পোশাক তৈরি করেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি সাধারণ পোশাকেরও বিক্রি বাড়ে পহেলা বৈশাখে। এই বছর তাদের ব্যবসায় আঘাত এনেছে করোনাভাইরাস। পহেলা বৈশাখে বেচাকেনার জন্য ব্যবসায়ীরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখায় তাতে লোকসানের মুখ দেখছেন তারা। এর সাথে সংক্রমণ ঠেকাতে সবকিছু বন্ধ থাকায় সামনের ঈদেও লোকসানের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংক্রমণের কারণে যদি ছুটি আরও বাড়ানো হয় তাদের ক্ষতি সামলিয়ে উঠা অনেকটা দুরূহ হয়ে যাবে। কাপড়ের বৃহত্তম পাইকারি বাজার নগরীর টেরিবাজার। টেরিবাজার থেকে চট্টগ্রামের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও ফেনীর কিছু কিছু স্থানে মালামাল নিয়ে বিক্রি করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। টেরিবাজারে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার দোকান আছে। সারাবছর বিকিকিনি হলেও যা ঈদকে কেন্দ্র করেই মূলত ব্যবসা হয়ে থাকে। টেরিবাজারের বিভিন্ন ধরনের পোশাকের বড় শো-রুমের একটি রাজপরী। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হুমায়ুন কবির মানিক জানান, করোনাভাইরাসের এ থাবায় তাদের বিপুল ক্ষতির কথা।
তিনি বলেন, ‘টেরিবাজারের ব্যবসা মূলত হয় রোজা ও তার আগের এক মাসে। এই দুই মাসেই আমাদের সারা বছরের আয় রোজগার উঠে আসে। যেটি এবার আমাদের পুষিয়ে উঠতে অনেক কষ্ট হবে’। তিনি জানান, গত ১৫ মার্চ বন্ধ শুরু হওয়ার আগেই তারা অনেকেই দোকানে মালামাল তুলেছেন। আবার দেশের বাইরেও মালামাল বুকিং করে রেখেছেন। আর তাদের সাথে অনেকের ব্যবসা হয় মালামাল বিক্রি করে টাকা পরিশোধের হিসেব করে।
মানিক বলেন, গত বছর আমাদের কাছ থেকে অনেকে মালামাল নিয়েছেন। তারা এবার সে টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু এবার তাদেরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সবারতো একই অবস্থা, টাকার জন্য কাউকে চাপও দেয়া যাবে না। এটা আমাদের জন্য চরম ক্ষতি’।
মানিকের দাবি, প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। অন্যান্য খরচও এর সাথে যুক্ত আছে।
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান জানান, প্রতিবছর ঈদের দুই মাস আগে থেকেই টেরিবাজারে বেচাকেনা শুরু হয়। সেজন্য ব্যবসায়ীরা কয়েক মাস আগে থেকে দেশের ও দেশের বাইরে থেকে মালামাল সংগ্রহ করে ফেলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিবছর শুধু ঈদে টেরিবাজারে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় দাবি করে মান্নান বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে মূলত এখানকার ব্যবসা জমজমাট হয়। সারাবছর যে পরিমাণ বেচাকেনা হয় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি বেচাকেনা হয় ঈদের দুই মাসে। প্রতিবারের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক কিংবা বিভিন্ন ভাবে ঋণ নিয়ে মালামাল দোকানে তুলে ফেলেছেন। এক মাসের বন্ধ থাকায় আমরা দিশেহারা’।
ব্যবসায়ী নেতা মান্নান আরও বলেন, টেরিবাজারের এক একটা শোরুমে ৫০ থেকে ১০০ জন কিংবা তার বেশি কর্মচারী রয়েছে। তাদের বেতন দিতে মাসে খরচ হয় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এক মাসের বন্ধে এক টাকাও আয় করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। ঈদের পাশাপাশি পহেলা বৈশাখেও টেরিবাজারে ভালো একটা বেচাকেনা হয়। কিন্তু এবছর সেটাও হয়নি। নববর্ষ কেন্দ্রীক পোশাকগুলো পড়ে থাকবে দোকানে।
মান্নান বলেন, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার বন্ধ ঘোষণা করেছে। সামনে কী পরিস্থিতি হয় সেটা এখনও কেউ জানে না। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘সরকার বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা দিচ্ছে। আমরা পাব কিনা জানি না। আমরা চাই আমাদেরও কিছু প্রণোদনা দেয়া হোক। ব্যবসা না হলেও ব্যাংক সুদ, ট্যাক্স আমাদের দিতে হবে। আমরা সেগুলো মওকুফের পাশাপাশি সরকারি প্রণোদনা চাই’।
নগরীর বেচাকেনা হওয়া আরেকটি মার্কেট পৌর জহুর হকার্স মার্কেট। ধনী গরীর সব শ্রেণির মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে বাজার করতে পারেন এই মার্কেটে। এই মার্কেটটিতে আছে অন্তত সাড়ে নয়’শ দোকান। টেরিবাজারের ব্যবসায়ীদের মতো তারাও বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে যে ক্ষতি ব্যবসায় হচ্ছে তা পুষিয়ে নিতে তাদের অনেক বেগ পেতে হবে। নগরীর অন্যতম একটি বাজার তামাকুমু-ি লেন ও রেয়াজউদ্দিন বাজার। পোশাক, কসমেটিকস, ইলেক্ট্রনিক্স, ক্রোকারিজসহ নানা ধরনের দোকান এই মার্কেটে। সারাবছর ক্রেতা সমাগম থাকা এই মার্কেটটি পোশাকসহ নগরবাসীর সব ধরনের জিনিসের চাহিদা মেটায়।
তামাকুমু-ি লেন বণিক সমতির সাধারণ সম্পাদক আহমেদ কবির দুলালের ধারণা এ বছর ঈদের বাজারে করোনার প্রভাবে তাদের ব্যবসা কম হবে। যেটি ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতি। তিনি বলেন, সারাবছর তামাকুমু-ি লেনে ব্যবসা হলেও ঈদের সময় তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তবে এবারের ঈদ বাজারে ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির শিকার হবেন।
তিনি জানান, পোশাকের পাশাপাশি তাদের মার্কেটগুলোতে অন্যান্য মালামালের বেচাকেনা বাড়ে ঈদের আগে। যার কারণে ঈদের কয়েক মাস আগে থেকে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুুতি নিতে থাকেন ঈদের বিক্রির জন্য। তবে এবার বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিতে চীনসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় অনেক ব্যবসায়ীর মালামাল আটকে গেছে। যার কারণে ঈদের জন্য অন্যবার যে ধরনের প্রস্তুুতি ব্যবসায়ীরা নিতেন তা নিতে পারেননি বলে জানান ব্যবসায়ী নেতা দুলাল।
তিনি মনে করেন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এবছর তাদের বিক্রিও অন্যান্যবারের চেয়ে অন্তত ৬০ শতাংশ কম হতে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট