চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বন্দর-ইপিজেড-পতেঙ্গা

ত্রাণের জন্য ছুটছে মানুষ

আল-আমিন সিকদার

১৩ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৫৯ পূর্বাহ্ণ

  • ত্রাণের জন্য মসজিদ ও থানার সামনে ছুটছে মানুষ
  • চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরা, বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি

বিশ্বব্যাপী মরণ খেলায় মেতেছে করোনাভাইরাস। ছোঁয়াছে এ রোগটিতে বিশ্বে গড়ে প্রতিমিনিটে মারা যাচ্ছেন একজন করে মানুষ। বাংলাদেশেও মরণ ঝাল বিস্তার করে চলেছে ভয়াবহ রোগটি। সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষণা করেছেন সাধারণ ছুটি। আক্রান্তের সংখ্যার সাথে সাথে বাড়ানো হচ্ছে ছুটির মেয়াদও। ঘোষণা অনুযায়ী বন্ধ রয়েছে বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসসহ কাখানাসমূহ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে বহু মানুষ। মাস ভিত্তিক কারখানাগুলেতে শম দেয়া মানুষগুলোর কিছু সংখ্যক বেতন পেলেও অর্থ সংকটে পড়েছে দিনমজুররা। যার দরুণ প্রথম ধাপের টানা ১০ দিনের সাধারণ ছুটিতেই খাবার সংকটে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। যাদের সহযোগিতা করতে জেলা প্রশাসকদের ত্রাণ দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন সরকার। কিন্তু সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে ত্রাণ প্রত্যাশীদের সংখ্যা।
জেলা প্রশাসকরা সরকারি ত্রাণ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করলেও ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও পূরণ করতে পারেননি। এমনটাই মন্তব্য খোদ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। তাইতো নগরীর শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বন্দর, ইপিজেড ও পতেঙ্গা এলাকার কর্মহীন মানুষগুলোকে ত্রাণের আসায় ছুটতে দেখা গেছে সড়কের পাশের বড় বড় মসজিদ ও থানাগুলোর সামনে। এই অঞ্চলটিতে বসবাসরত প্রায় ১৫ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১ লাখেরও বেশি পরিবার নিম্ন বিত্ত হলেও ত্রাণ পায়নি তারা। সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই ত্রাণ বিতরণ করলেও ঘাটতি রয়ে গেছে অনেক। সরকারি ত্রাণ এসেছে মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে এখানকার ১৫ শতাংশ অসহায় পরিবার ত্রাণ পেলেও বঞ্চিত রয়েছে ৮৫ শতাংশ পরিবার।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্দর, ইপিজেড ও পতেঙ্গা থানাধীন শহরেরে দক্ষিণাঞ্চলে বেশকিছু বস্তি রয়েছে। শ্রমিক অধ্যুষিত এই এলাকায় শ্রমিকদের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কয়েকটি জেলে পাড়া। শুধুমাত্র বন্দর থানাধীন ৩৭ নং ওয়ার্ডের আনন্দ বাজার এলাকার চাঁন্দাপাড়া থেকে টিজি কলোনি পর্যন্ত প্রায় ৩৯টির মত ঘনবসতি রয়েছে। যা বস্তি হিসাবে পরিচিত। যেখানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবারে ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। যাদের অধিকাংশ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ডিপোর উপর নির্ভরশীল। আবার এর মধ্যে রয়েছে রিক্সা চালক, দিনমজুর, ভ্যান চালক, গার্মেন্টস কর্মীসহ নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ভোলা, লক্ষীপুর, নোয়াখালী, সন্দ্বীপ এবং হাতিয়া থেকে আগত নদী ভাঙ্গা অসহায় হতদরিদ্র পরিবারেরগুলোর বসবাস এখানে। কিন্তু এখানকার অর্ধেকেরও বেশি পরিবার পায়নি ত্রাণ।
অন্যদিকে ইপিজেডের বেশ কয়েকটি এলাকা পরিচিত শ্রমিক এলাকা হিসেবে। এরমধ্যে রয়েছে বন্দরটিলা, বাহাদুর কলোনী, আকমল আলী রোড, সিমেন্ট ক্রসিং ও নারিকেল তলা। যেখানে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিকের বসবাস। এছাড়াও রেললাইনস্থ একটি জেলে পাড়াও রয়েছে এখানে। যেখানে প্রায় শতাধিক লোকের বসবাস। অথচ এই এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ এসেছে মাত্র সাড়ে ৩শ পরিবারের জন্য। যদিও স্থানীয় কাউন্সিলর, থানা পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে এখানে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণ সরবরাহ করা হয়। তবুও চাহিদার ৬ ভাগের একভাগও পূরণ করা যায়নি। তাইতো শ্রমিক অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষের জন্য সরকারের কাছে বাড়তি বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
এদিকে দুইটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল ইপিজেডের একটি পতেঙ্গা এলাকায় হওয়ায় সেখানেও বসবাস করেন ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। আছে একটি প্রাচীন জেলে পাড়া। এখানেও বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো। তাইতো এই অঞ্চলগুলো ঘুরে দেখা যায়, ত্রানের জন্য মানুষের হাহাকার।
পতেঙ্গা মুসলিমাবাদ এলাকায় বসবাসরত সেলুন দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দত্ত জানান, ‘করোনাভাইরাসের কারণে দোকান বন্ধ। পরিবার নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছি। বিভিন্ন সরকারি হট লাইনে ফোন করলে সারাক্ষণ নাম্বারগুলো ব্যস্ত থাকে। খাবার যোগাতে পারছি না। কাউকে লজ্জায় বলতেও পারছি না’।
কাটগড় হিন্দু পাড়ায় বসবাসরত পোশাক কারখানার শ্রমিক ফণী ভুষন দেবনাথ জানান, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো খুবই অসহায়, কারখানা বন্ধ। কারও কাছে কিছু হাত পেতে চাইতে পারি না। অনটনে দিন কাটে।
পতেঙ্গা এলাকার রাজমিস্ত্রি মো. আব্দুল খালেক বলেন, করোনার কারণে হাতে কোন কাজ নেই। কোথাও থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি। খুব টানাপোড়ার মধ্যে সংসার চালাচ্ছি। ত্রাণ পেলে কয়েকটা দিনের জন্য অন্তত নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। আমরা ত্রাণ না পেলে সরকারি ত্রাণ সহায়তা কাদের জন্য বলে প্রশ্ন করেন তিনি।
আনন্দবাজার এলাকায় বসবাসরত মো. ইব্রাহীম ফরাজী বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে লকডাউনের সময় আনন্দ বাজার এলাকার বস্তিবাসী এখনও পর্যন্ত কোন ত্রাণসামগ্রী পাননি যা খুবই দুঃখজনক। এখানকার অধিাংশ মানুষের কর্মসংস্থান ময়লার ডিপোর উপর যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক কুঁকিপূর্ণ।
জেলা প্রাশসকের দেয়া সরকারি ত্রাণ দিয়ে কতটুকু মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছেন জানতে চাইলে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডটি সম্পূর্ণ শ্রমিক অধ্যুষিত একটি এলাকা। এখানে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার দরিদ্র। যাদের ত্রাণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে ত্রাণ এসেছে সাড়ে ৩শ পরিবারের। তবুও আমি নিজ উদ্যোগে প্রায় ৪ হাজার এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের মাধ্যমে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ হজার ত্রাণ বিতরণ করেছি। যা চাহিদার ৭ ভাগের এক ভাগ। ধীরে ধীরে আমরা সকলের ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেবো। এজন্য অন্যান্য এলাকার চেয়ে এখানে সরকারের বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিও জানান তিনি’। একই দাবি জানিয়েছেন এই অঞ্চলের অন্যান্য ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও।
এদিকে নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। থানার মাধ্যমে অসহায় পরিবারদের দেয়া হচ্ছে ত্রাণ। তবে এ ত্রাণ চাহিদা পূরণে সম্ভব নয় বলে জানান থানায় দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট