চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

দিশেহারা ৯ শতাধিক দুগ্ধ খামারি

কর্ণফুলী-রাঙ্গুনিয়া সংবাদদাতা

৪ এপ্রিল, ২০২০ | ২:৩০ পূর্বাহ্ণ

  •  দই-মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় কিনছেনা দুধ।
  • বাড়িবাড়ি ফেরি করে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্ধেকের কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
  • গরুর খাদ্য, ঋণের প্রিমিয়ামের টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না।
  • আর্থিক প্রণোদনার দাবি।

করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বিপাকে পড়েছেন কর্ণফুলী ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ৯ শতাধিক গরুর খামারি। কোন কোন খামারি নামমাত্র মূল্যে দুধ বিক্রি করছেন, আবার অনেক খামারি দুধ থেকে ননি তুলে রেখে ক্ষতি কিছুটা পোষানোর চেষ্টা করছেন। চলমান সংকটে এসব খামারিরা বিপুল অংকের ক্ষতির আশংকা করছেন।
কর্ণফুলী : করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে সাধারণ ছুটির আওতায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে নগরীর দই-মিষ্টির দোকান ও চায়ের দোকান। শহরের বসবাস করা অধিকাংশ মানুষ লম্বা ছুটি পেয়ে সপরিবারের চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। এদিকে কর্ণফুলী উপজেলায় অবস্থিত দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কারখানা মিল্কভিটার দুগ্ধশীতলকরণ কেন্দ্রটিও বন্ধ রয়েছে। ফলে খামারে উৎপাদিত দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শহরতলীর উপজেলা কর্ণফুলীর সাত শতাধিক গরুর খামারি। কোন কোন খামারি নামমাত্র মূল্যে দুধ বিক্রি করছেন। আবার কোন কোন খামারি নামমাত্র মূল্যেও বিক্রি করতে পারছেন না। এতে ব্যাপক লোকসানের মুখে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন ‘ডেইরি জোন’ হিসেবে পরিচিত এ উপজেলার খামারিরা। লোকসান কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
উপজেলার চরলক্ষ্যা, চরপাথরঘাটা ও শিকলবাহা এলাকার দুগ্ধ খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খামারিদের দুধ বিক্রির প্রধান ভরসা মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন দই ও মিষ্টিজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে ছোটবড় সব কারখানা বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও শহরেরর বাসাবাড়িতেও কমে গেছে দুধের চাহিদা। দই-মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকার কারণে তারাও কিনছেন না দুধ। এ কারণে গ্রামে বাড়িবাড়ি ফেরি করে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে দুধ।
ইছানগরের দুগ্ধ খামারি এন্তেজার উদ্দিন জানান, দৈনিক আমার খামারে উৎপাদিত ৫০০ কেজি দুধ বিক্রি করতাম। এখন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও নামমাত্র মূল্যে দুই আড়াইশত কেজি বিক্রি করতে পারছি। বাকি দুধ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ডেইরি ফার্ম এসোসিয়শনের সভাপতি হারুন চৌধুরী বলেন, করোনার প্রভাবে দুধ বিক্রি নেই বললে চলে। কিন্তু আমরা তো গরুকে খাবার দেয়া বন্ধ রাখতে পারি না। ফলে খামারিরা লোকসান দিতে দিতে পথে বসার উপক্রম। সরকারের কাছে আমরা গার্মেন্টস খাতের মত এ খাতেও আর্থিক প্রণোদনার দারি করছি।
মিল্কভিটার পরিচালক নাজিম উদ্দিন হায়দার বলেন, করোনার প্রভাবে দুধ বিক্রি না হওয়ায় উপজেলার সাত শতাধিক খামারি প্রতিদিন বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকার যদি গার্মেন্টস খাতের মত এ খাতে আর্থিক প্রণোদনা না দেয় দুগ্ধখাত পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। বেকার হয়ে পড়বেন এখাতে নিয়োজিতরা ।
রাঙ্গুনিয়া : উপজেলায় রয়েছেন ৩১ জন দুগ্ধ খামারি। তাঁদের উৎপাদিত দুধ নিয়ে চলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মিষ্টির দোকানসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এমনকি রাঙ্গুনিয়ায় উৎপাদিত দুধ নিয়ে যেতো রাঙ্গামাটি-বান্দরবান এলাকার বিভিন্ন সেনাবাহিনী ও বিজিবি ক্যাম্পেও। তবে এখন দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দুগ্ধ খামারিরা। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দুধের চাহিদা একেবারেই পড়ে যাওয়ায় খামারিরা পানির দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোথাও কোথাও দুধ ফেলেও দিতে হচ্ছে। তবে অনেক খামারিই এখন দুধ থেকে ননি তুলে রেখে ক্ষতি কিছুটা পোষানোর চেষ্টা করছেন। এ পদ্ধতিতে ননি তুলে রেখে বাকি দুধ ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
খামারিরা বলছেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই খামারিদের দুধ বিক্রির প্রধান জায়গা। কিন্তু রাঙ্গুনিয়া ও আশেপাশের ছানা, ঘি ও মিষ্টি তৈরির কারখানা বন্ধ। প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ নেওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। একদিকে গরুর খাদ্যের দাম কয়েকদিনে বেড়ে গেছে, অন্যদিকে দুধ বিক্রির জায়গা নেই। ফলে করোনার যাতাকলে চরম বিপাকে পড়েছেন উপজেলার বড় ৩১টি দুগ্ধ খামারসহ ছোট বড় দুই শতাধিক দুগ্ধ খামারি।
সরেজমিনে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়নে এ এস ডেইরি খামারে গিয়ে দেখা যায়, এই খামারের ৪০টি গরুর দুধ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন খামার মালিক উপজেলা ডেইরি এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. এয়াকুব। তিনি ৪০টি গরু থেকে প্রতিদিন ৩’শ লিটার দুধ পেয়ে থাকেন। করোনা পরিস্থিতির আগে এ দুধ রাঙ্গামাটি-বান্দরবানের বিভিন্ন সেনা ক্যাম্প সহ আশেপাশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেত এবং বাকি দুধ দিয়ে তার নিজের মিষ্টির দোকানে বিভিন্ন রকম মিষ্টি বানিয়ে বিক্রি করতেন। কিন্তু গত ২৫ মার্চ থেকে করোনা পরিস্থিতিতে কেউ দুধ নিতে যায় না তাঁর খামারে। অন্যদিকে দোকানও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বেড়েছে গরু খাদ্যের দামও। ঋণ নিয়ে গড়া এই খামারের মিষ্টি বিক্রি করতে না পারায় গরুর খাদ্য কেনা থেকে ঋণের প্রিমিয়ামের টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফার্ম ও দোকান চালু করেছিলেন। প্রতিমাসে ২ লাখ ৭১ হাজার টাকা ঋণ দিতে হয়। কর্মচারী ও অন্যান্য খরচে যায় আরো ৩ লাখ টাকা। প্রতিদিন গড়ে যে পরিমাণ দুধ পেতাম তা বিক্রি করে মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু ৭/৮ দিন যাবত করোনায় অঘোষিত লক ডাউনের কারণে কেউ দুধ নিতে আসেনা, সরকারি আদেশে দোকানও বন্ধ। সবমিলিয়ে চরম বেকায়দায় আমার মতো উপজেলার ৩১জন দুগ্ধ খামারি। এভাবে আর কিছু দিন চলতে থাকলে সবার ভিটামাটি বিক্রি করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
উপজেলা ডেইরি এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘গরুর খাদ্যের দাম কয়েক দিনে বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই আমরা কাহিল। এর ওপর দুধ বিক্রির জায়গা নেই। করোনার কারণে আমরা পথের ফকির হয়ে যাচ্ছি’।
উপজেলা প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের উপ-সহকারী প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা দ্বিন মোহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের আর্থিক সহযোগিতার কোন খাত নেই। তবে এই ব্যাপারে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে আমরা খামারিদের প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট