চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

হাঁচি-কাশির রোগী মানেই কি ‘করোনা’!

সরকারি হাসপাতালে বাড়ছে বিড়ম্বনা

ইমাম হোসাইন রাজু

১৮ মার্চ, ২০২০ | ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ

পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা রহিম উদ্দিন (ছদ্মনাম)। পেশায় কৃষক। বছর দু’য়েক আগ থেকে হৃদরোগে ভুগছেন তিনি। চারদিন আগে থেকে হঠাৎ সর্দি-কাশি পেয়ে বসে। সমস্যা বাড়ে হৃদরোগেরও। উপায়ন্তর না দেখে গতকাল মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন তিনি। কিন্তু চিকিৎসা নিতে এসেই পড়ে যান ঝামেলায়। ষাটোর্ধ্ব এ বৃদ্ধকে পড়তে হয় নানা হয়রানি ও বিড়ম্বনায়। সর্দি- কাশির কথা শুনেই কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে সোজা ফৌজদারহাট সংক্রমক ব্যাধি (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে এমন সন্দেহের বশে এভাবেই চমেক হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের গত কয়েকদিন ধরে হেনস্তা হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা।
শুধু চমেক হাসপাতালই নয়, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে নগরীর সরকারি হাসপাতালগুলোতেও।
রহিম উদ্দিন (ছদ্মনাম) পূর্বকোণকে বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে বহিঃবিভাগ, জরুরি বিভাগ ও ওয়ার্ডে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। তারা কেউই আমার চিকিৎসা করতে পারবে না বলে আমাকে ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বলেন। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষার পরও চিকিৎসা না পেয়ে জেনারেল হাসপাতালে ছুটে যাই। কিন্তু সেখানেও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আমাকে।’
বিষয়টি প্রতিবেদকের নজরে আসার পর চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই রহিম উদ্দিনকে (ছদ্মনাম) চিকিৎসা দিতে রাজি হন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসকরা। চিকিৎসক তাকে ওষুধ লিখে দেন এবং বাসায় রেস্টে থাকার পরামর্শ দেন।
গত রবিবার রাতেও এমন ঘটনা ঘটে চমেক হাসপাতালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত জর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা এক ব্যক্তিকে নিয়ে রাতভর একরকম নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাত কেটে গেলেও করোনা আতঙ্কে এই ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন নার্সসহ চিকিৎসকরা। বাধ্য হয়ে সিভিল সার্জনের নির্দেশে পরদিন সোমবার দুপুরে ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে পাঠানো হয় রাতভর চিকিৎসার আশায় থাকা ওই রোগীকে। পরে সেখানে সাধারণ চিকিৎসা নিয়েই বাড়ি ফিরেন তিনি। পরিবারের স্বজনেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সারারাত চিকিৎসা না দিয়ে পরে বাধ্য হয়ে ভর্তি করানোর পর রোগীর শরীরে করোনাভাইরাসের কোন লক্ষণই পাওয়া যায়নি।
যদিও, তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এমন ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ দায় এড়াতে চেয়েছেন।
শুধু চমেক হাসপাতালেই এমন ঘটনা ঘটছে বিষয়টি এমনই নয়, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালেও গত কয়েকদিনে এমনটি ঘটেছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অসহায় রোগীরা।
শুধু রোগীরাই নয়, পরপর এমন ঘটনায় অনেকটাই উদ্বিগ্ন স্বয়ং স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সব জ¦র-সর্দি কাশি করোনাভাইরাসের লক্ষণ নয়। তাই সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে আরও বেশি যত্মবান হতে হবে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকসহ সকলকে অবহিত করা হবে বলে জানিয়েছেন ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি পূর্বকোণকে বলেন, ‘বুধবার (আজ) সিটি কর্পোরেশনে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশাসনসহ নগরীর সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধানদের নিয়ে জরুরি সভা হবে। সেখানেই এ বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। একই সাথে চিকিৎসার বিষয়ে যেন কোন ঘাটতি না থাকে সে বিষয়েও সবাইকে অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি।’
এদিকে সকল জ¦র-সর্দি ও কাশি হলেই যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, এমনটি মোটেও সঠিক নয় উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান মৌসুমে সর্দি-কাশিসহ নিউমোনিয়া হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে এটাকে করোনাভাইরাসের লক্ষণ ভেবে আতঙ্কি হয়ে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না এটা মোটেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে নেই।
অন্যদিকে, রোগীদেরও আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেন, রোগীরাও যদি তাদের বিষয়টি গোপন করে চমেক হাসপাতাল কিংবা ঘনবসতি এলাকায় এসে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাহলে তিনি যে পথ ধরে হেঁটে যাবেন তার আশপাশেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়বে। তাই এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগিতা নেওয়ার আহ্বান স্বাস্থ্য দপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীরের।
তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যদি নিজেই বুঝতে পারে-তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত। তাহলে স্বাস্থ্য বিভাগের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করলে মেডিকেল টিম নিজ দায়িত্বে বাড়িতে গিয়ে সেবা প্রদান করবেন। তাকে হাসপাতালে আসতে হবে না। কেননা একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে অন্যরাও আক্রান্ত হবেন। তাই এ বিষয়ে সকলকেই সচেতন হতে হবে।’
দীর্ঘদিন থেকে ভাইরাস ডিজিজ নিয়ে গবেষণা করা ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে চিকিৎসকরাই। যার কারণে চিকিৎসকরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। এটা সত্য। কিন্তু চিকিৎসা না দিয়ে একজন রোগীকে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো উচিত নয়। সবাইকে মনে রাখতে হবে- সকল জ¦র-সর্দি কাশি করোনার লক্ষণ নয়। প্রথমেই তার রোগের ইতিহাস জানা উচিৎ। তারপর কী চিকিৎসা হবে সেটি ভাবতে হবে। এটাও মাথায় রাখতে হবে-রোগীরা যদি তথ্য গোপন করে চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয়, তাহলে সেটিও উচিত নয়। কেননা এটি বড় একটি সমস্যা। যাতে সংক্রমণ বেড়ে যাবে। তাই সকলকেই এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকের।’
নতুন আরও দুই জন হোম কোয়ারেন্টাইনে : প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও দুইজনকে হোম কোয়ারেন্টাইনের রাখা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ইতালি থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে চট্টগ্রামে আসেন এ দুই বাংলাদেশি। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৩১ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি পূর্বকোণকে বলেন, ‘নতুন করে ইতালি থেকে আসা এসব ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের সকলের নাম-ঠিকানা স্বাস্থ্য বিভাগ সংগ্রহে রেখেছেন। তাদের বিষয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নজরদারি রাখতে বলা হয়েছে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট