চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

চাঁদা-দাদনের বেড়াজালে নিঃস্ব জেলেরা
চাঁদা-দাদনের বেড়াজালে নিঃস্ব জেলেরা

চাঁদা-দাদনের বেড়াজালে নিঃস্ব জেলেরা

আয়তন: ৫ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা: ৩ লাখ ৫০ হাজার,ভোটার: ৪৯ হাজার ৮৯০ জন

আল-আমিন সিকদার

৯ মার্চ, ২০২০ | ৩:২০ পূর্বাহ্ণ

মূল শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের অবস্থান। এখনো অনেকটাই গ্রামীণ আবহ রয়ে গেছে ওয়ার্ডটিতে। গ্রামের মতই এখানে আছে ফসলের জন্য বিস্তীর্ণ জমি, পুকুরে মাছের চাষ আর নদী-সাগরে গেলে দেখা যায় জেলেদের মাছ ধরার নৌকার সারিবদ্ধ নোঙরের দৃশ্য।
এককথায় শহুরে সুবিধা নিয়ে গ্রামীণ জীবন-যাপনের স্বাদ নেয় এই ওয়ার্ডের বাসিন্দাগণ। তবে ধীরে ধীরে এখানে কমতে বসেছে আবাদি জমির পরিমাণ। শিল্পায়নের কারণে শিল্পকারখানাসহ নানা ব্যবসায়িক ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে এখানে। এসব কারণে এই ওয়ার্ডটিকে অনেকে শিল্প এলাকা বলে থাকেন।
এখানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর প্রধান দপ্তর। যেমন পদ্মা, মেঘনা ও যুমনাসহ ইস্টার্ন রিফাইনারির কার্যালয়। এছাড়াও এই ওয়ার্ডের সীমানায় পড়েছে চট্টগ্রাম শহরের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল, কর্ণফুলী ইপিজেড। রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এম এ আজিজ উদ্যান, শিব ও কালী মন্দির। আছে বিশাল বিশাল ট্রাকের স্ট্যান্ড। এমনকি চট্টগ্রামের বৃহৎ ফ্লাইওভার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও শুরু হয়েছে এই এলাকা থেকে। ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে এই এক্সপ্রেসওয়ের বেশ কয়েকটি পিলার।
শিল্পায়ন আর উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাওয়া এই ওয়ার্ডটিতেও রয়েছে নানা সমস্যা আর অনিয়মের অভিযোগ।
মুসলিমাবাদ জেলে পাড়ার জেলেদের অভিযোগ, মাঝ সাগরে জাল ফেলতে হলে আগে চাঁদা দিয়ে ভাড়া নিতে হয় মাছ ধরার এরিয়া। শুধু তাই নয়, দাদনের বেড়াজালে নিঃস্ব এখানকার জেলে পাড়ার বহু জেলে। খাওয়ার জন্য নেই বিশুদ্ধ পানি, রান্নার জন্য সময়মত গ্যাসও পায় না এখানকার মানুষ। নেই হাসপাতাল ও শিক্ষার জন্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানকার শিক্ষার্থীদের ভরসা একমাত্র পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়। তবে একটি মহিলা কলেজ থাকলেও নেই পুরষদের জন্য কোন শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা। এছাড়াও খেলার মাঠের সংকটের কথাও জানিয়েছেন তরুণরা।
এছাড়াও এই এলাকার প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ড্রেনগুলো যেন এক একটি আবর্জনার ভাগাড়। অবশ্যই এর জন্য স্থানীয়রাই অনেকটা দায়ী। কারণ, খাল ও ড্রেনগুলোতে বালতি ভর্তি আবর্জনা ফেলতে দেখা গেছে স্থানীয়দের।
জেলে পাড়া এলাকার বাসিন্দা ভগিরত জলদাশ। পেশায় একজন জেলে। জেলেদের সম্মুখিন হওয়া সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় একটি ঘাট না থাকায় আমাদের মালামাল আনা-নেয়া এবং যাতায়াত করতে খুবই কষ্ট হয়। আমরা স্থানীয় জেলে এবং দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় মাছ ধরে আসছি। তবে মাছ ধরার মৌসুমে বাহির থেকে নৌকা এসে আমাদের মাছ ধরতে দেয় না। আর আমাদের এলাকায় খাবার পানির খুবই সংকট রয়েছে। ওয়াসার সংযোগও আমরা পাইনি, যার কারণে আমাদের পানি কিনে খেতে হয়’।
তরুণ ভোটার সুমন দাশ বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ময়লা আবর্জনা খুবই বেশি, আর ঠিকমতো আবর্জনা অপসারণ করা হয় না। এছাড়া খাওয়ার পানির সংকটের কারণে আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়তে হয়। ওয়াসার সংযোগ না থাকার কারণে আমাদের পানি কিনে খেতে হয়। খেলার মাঠের অভাবের কারণে শিশু-কিশোররা ঠিকমতো খেলাধুলা করতে পারে না’।
এসব সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন বর্তমান কাউন্সিলর হাজি মো. জয়নাল আবেদীন। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘দাদন ও চাঁদাবাজি সমস্যার সমাধানে জেলেদের আমি একটি সমবায় সমিতি করে দিয়েছিলাম। যা তারা রক্ষা করতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০১০ এর পরে এই চাঁদাবাজি শুরু হয়। যা তৎকালীন প্রভাবশালীরা জেলেদের সাথে ব্যবসার নামে চাঁদাবাজি শুরু করে’।
ওয়াসার পানির সংকট নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওয়াসার পানি সরবরাহ না থাকায় আমাদের ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের পানি কিনে খেতে হয়। এই সমস্যার কথা জানিয়ে মেয়রের মাধ্যমে ওয়াসাকে আমি চিঠিও দিয়েছি। বর্তমানে স্টিলমিল পর্যন্ত ওয়াসার লাইন চলে এসেছে। ২০২০ সালের মার্চের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। আশা করছি খুব শীঘ্রই এই ওয়ার্ডের সর্বত্র ওয়াসার সংযোগ পৌঁছে যাবে’।
স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল করার জন্য মেয়র মহোদয়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছি। তারই আলোকে জেলা প্রশাসক একটি স্থান নির্বাচনের জন্য সার্ভে করে গিয়েছেন। এই বিষয়ে আমি সবসময় যোগাযোগ রাখছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই এই কাজ শুরু হবে’।
বিগত সময়ে ওয়ার্ডের উন্নয়নে প্রায় ৬০ কোটি টাকার বরাদ্দ পেয়েছেন এ কাউন্সিলর। ৬০টি সড়ক ও ড্রেনের সংস্কার কাজসহ বেশ কিছু কর্মকা-ে ৩১ কোটি টাকার কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছেন তিনি। এরমধ্যে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন ডিগ্রি কলেজের ৬ তলা নতুন ভবন নির্মাণ, ১৫ টি ড্রেন ও সড়কের সংস্কারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ২৯ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে।
আসন্ন সিটি নির্বাচনে দলীয় সমর্থন না পাওয়ায় কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার দৌড়ে আছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবদুল বারেক, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ হারুন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. ফরিদুল আলম।
৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল বারেক আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় সমর্থনে কাউন্সিলর পদে লড়বেন। নির্বাচনে জয়লাভ করলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর সাথে সমন্বয় করে এলাকার সকল খাল খনন, বিশুদ্ধ পানির সংকট মেটাতে ওয়াসার সহযোগিতায় কাজ করা এবং মাদক, সন্ত্রাস ও জুয়া নির্মূলের পাশাপাশি কিশোর গ্যাং দমনে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। এছাড়াও ১১ আসনের সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় একটি কলেজ, একটি হাসপাতাল এবং দুইটি খেলার মাঠ নির্মাণের ইচ্ছা রয়েছে তার।
ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ হারুন বিএনপি থেকে দলীয় সমর্থন পাওয়ায় আসন্ন সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নির্বাচিত হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তা সংস্কার, সুপেয় পানির সংকট উত্তরণে ওয়াসার সাথে সমন্বয় করে কাজ করার কথা জানিয়েছেন। এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ওয়ার্ডবাসীর জন্য একটি হাসপাতাল ও বয়েজ কলেজ নির্মাণের আশা ব্যক্ত করেছেন তিনি।
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মো. ফরিদুল আলম। নির্বাচনে জয়লাভ করলে তিনি এলাকার নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার করা, জেলে সম্প্রদায়ের দাদন ও চাঁদাবাজি সমস্যার সমাধান, কাঠগড় ও স্টিলমিল বাজারের আধুনিকায়নে কাজ করবেন। এছাড়া ওয়াসার সহযোগিতায় ওয়ার্ডের সুপেয় পানির অভাব মেটানো এবং নিজ উদ্যোগে পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়কে কলেজে বর্ধিত ও সরকারিকরণের ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট