চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মধ্যরাতে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপে সশস্ত্র সংঘর্ষ, আহত অর্ধশত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৭ জন আটক, পরে মুক্ত ৮৭টি রুম ভাঙচুর, লুটপাট ৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি , ফাঁকা গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ

রায়হান উদ্দিন , চবি

৬ মার্চ, ২০২০ | ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বুধবার, রাত ১টা। এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে সবাই। হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি। বহু কণ্ঠের স্লোগান। অসংখ্য কণ্ঠের গুঞ্জরণ। মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ। আহতদের আর্তনাদ। যেন রণক্ষেত্র পুরো ময়দান। গতকাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিণতি এটি।

দিবাগত রাত একটা থেকে শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপ বিজয়ের সাথে কনকর্ড ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের মধ্যে ঘণ্টাব্যাপী চলে এ সংঘর্ষ। এতে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এসময় ছয় রাউন্ড ফাঁকা গুলি, পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হলের ৮৭টি রুম ভাঙচুর ও লুটপাট করে হামলাকারীরা। এ ঘটনায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৫৭ জন নেতাকর্মীকে আটক করে। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই করে সাতজন ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। উত্তেজনা বিরাজ করছে উভয় গ্রুপে। যেকোনো সময় আবারো বড় ধরনের সংঘর্ষের আশংকা রয়েছে।
আহতদের মধ্যে দর্শন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মিনহাজ, সংস্কৃত বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের মো. মুজাহিদুল, সমাজতত্ত্ব বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের আকতার হোসেন বিজয়, শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের একই শিক্ষাবর্ষের
। ৯ম পৃষ্ঠার ৫ম ক.­

সাখাওয়াত চৌধুরী, অর্থনীতি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শহিদুল ইসলাম, একই বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের জামিল হাসান, নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ফরহাদ, একই বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এজাজ আহমেদ নিশান, লোক প্রশাসন বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের মেহেদী হাসান, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের সাহেল মিয়া, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ফাহিম হোসেনের নাম জানা গেছে। আহতদের মধ্যে অন্তত ৩৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। আরো ১৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

যাচাই বাছাই শেষে আটকৃতরা হলেন, সিক্সটি নাইনের রসায়ন বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের গোলাম শাহরিয়ার, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জোবায়ের আহমেদ নাদিম, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের মাশরুর অনিক, পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আকিব জাবেদ, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের রুম্মান ও হায়দার। বিজয় গ্রুপের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের জিন্নাত মজুমদার ও কনকর্ড গ্রুপের জিসান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এক কর্মীকে কুপিয়ে জখম করার জের ধরে দিনব্যাপী সংঘর্ষের পর বুধবার রাত একটার দিকে ছাত্রলীগের বিজয় গ্রুপের উপর একজোট হয়ে হামলা চালায় কনকর্ড ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতাকর্মীরা। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহওয়ার্দী হলে ভাঙচুর চালিয়ে বিজয়ের কর্মীদের হল থেকে বের করে দেয় কনকর্ড ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল থেকে বিজয় গ্রুপের কর্মীরা বের হলে মুখোমুখি হয় উভয় গ্রুপ। পরে বিজয় গ্রুপ এ এফ রহমান হলের ভিতরে এবং কনকর্ড ও সিক্সটি নাইন গ্রুপের কর্মীরা হলের সামনে অবস্থান নিলে উভয় পক্ষের মধ্যে চলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। ছয় রাউন্ড ফাঁকা গুলি ও পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। এসময় হলের লাইট ভেঙে অন্ধকারে ৮৭টি রুম, পাঁচটি মোটরবাইক কুপিয়ে ভাঙা হয়। অনেকগুলো রুমে লুটপাট চালিয়ে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়। একই সাথে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের গণহারে মারধর করে উভয় গ্রুপ। এতে দুই গ্রুপের অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হয়। পরে রাত ২টার দিকে পুলিশ আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চিপ মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, ‘এখন পযন্ত ৩৭ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেকে পাঠানো হয়েছে’।
বিজয় গ্রুপের নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, ‘মধ্যরাতে শিবির স্টাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর নেতৃত্বে আমাদের ঘুমন্ত কর্মীদের উপর নৃশংস হামলা হয়েছে। বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে, গুলি বর্ষণ করে ও ককটেল ফুটিয়ে এভাবে ছাত্রলীগের ছেলেদের উপর হামলার মানে হয় না। হলে ঢুকে অনেকগুলো রুম ভাংচুর করেছে তারা। আমাদের ছেলেদের কুপিয়েছে, হলের ছাদ, পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে, রুমগুলো থেকে ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকা ও মূল্যবান জিসিনপত্র নিতে লুটতরাজ চালিয়েছে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, সাধারণ ছাত্রদের মারধর করেছে এবং প্রতিবন্ধীর রুমও ভেঙেছে সন্ত্রাসী টিপুর অনুসারীরা’। তিনি আরো বলেন, ‘সে (ইকবাল হোসেন টিপু) যে কাজ করেছে তা কোন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করতে পারে না। আমরা তার অতীত ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে সন্দিহান। এই ইয়াবা ব্যবসায়ীকে সংগঠন থেকে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। আমরা এসব ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি’।

এদিকে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, ‘যে বা যারা এসব ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর মোহাম্মদ ইলিয়াসের বিরুদ্ধে আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাথে কথা বলেছি। তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহিরীর সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তার কোন ছাত্রত্ব নেই। সে ছাত্রলীগের কোন প্রোগ্রামেও আসে না। আর গত সাত মাসে তার নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে ১৫-২০ ঝামেলা হয়েছে। তার রাজনৈতিক আইডলজি নিয়ে সবাই সন্দিহান। এসব ঝামেলার সকল কিছুর নেপথ্য রয়েছে। সে আমার সংগঠনের কেউ না। সে অন্য মতাদর্শের’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘দুটি গ্রুপকে বারবার শান্ত থাকতে বলা হলেও সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে অনেকেই আহত হয়েছে। আমরা তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। তদন্ত কমিটি হবে, একটা মামলাও হবে। ৮৭টির মতো রুম ভাঙ্গায় প্রায় ৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আটকদের মধ্যে ৭ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
প্রসঙ্গত, গত পহেলা মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলে কনকর্ডের কর্মী বোরহানুল ইসলাম আরমানের সঙ্গে বাকবিত-া হয় আবির নামে বিজয়ের এক কর্মীর। এর জের ধরে গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে আবিরকে কুপিয়ে জখম করে কনকর্ডের কর্মীরা। এর রেশ ধরে বুধবার বিকেলে শাহ জালাল হলের সামনে দু’ গ্রুপ অবস্থান নিলে বিজয় গ্রুপের কর্মীরা তাদের ধাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে তাদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে ও সংঘর্ষ বাধে। এতে উভয় গ্রুপের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে অবস্থান নিয়ে উভয় পক্ষকে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় পুলিশ ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে চারজনকে আটক করে। বিবদমান বিজয় গ্রুপ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী এবং কনকর্ড ও সিক্সটি নাইন গ্রুপ দুটি সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

সংঘর্ষের ঘটনায় সমঝোতা, আটকদের মুক্তি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শাখা ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় সমঝোতার সিদ্ধান্তে এসেছেন বগি ভিত্তিক সংগঠনগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন। ফলে হল ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা না করে আটকদের মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দীর্ঘ তিন ঘণ্টার বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রক্টর এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে না জড়ানোর শর্তে আমরা মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যে ৭ জনকে আটক রাখা হয়েছে তাদের ছেড়ে দেওযয়া হবে। কিন্তু একাডেমিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশের নিরাপত্তায় বিভিন্ন হলে ঢুকতে না পারা ছাত্রলীগ কর্মীদের উঠিয়ে দেওয়া হবে।
বৈঠকে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, প্রক্টরিয়াল বডি, ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও বগি ভিত্তিক সংগঠনগুলো নেতারা এবং পুলিশ প্রশাসন উপস্থিত ছিলেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট