চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইসলামে নারীর অধিকার

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

৬ মার্চ, ২০২০ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

একটি আত্মা থেকে মানবের সৃষ্টি। সেই আত্মা থেকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে একজন নারীকে। আত্মাটি ছিল হযরাত আদম (আ.)-এর। সর্বপ্রথম সৃষ্ট ঐ নারী হলেন হযরত হাওয়া (আ.)। তাঁদের উভয়জন থেকে বিস্তার ঘটেছে মানবজাতির। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহর আলোকে মানব-সৃষ্টি এবং বিস্তারের এটিই সূত্র। তাই মানুষের লিঙ্গের ভিন্নতা থাকলেও তাদের উৎস একটি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, “মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি” (সূরা হুজুরাত: ১৩)। লিঙ্গের ভিন্নতার কারণেই মানুষের গঠন, আকৃতি, আবেগ-অনুভূতি ও স্বভাব-চরিত্রের ভিন্নতা সুস্পষ্ট। সুতরাং দায়িত্ব ও অধিকার ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই মূলত নারী অধিকার কথাটির প্রচলন হয়েছে। উপরন্তু যুগে যুগে নারীদেরকে অধিকার বঞ্চিত করা হয়েছে বিধায় ‘নারী অধিকার’ পরিভাষার সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের বিধানালোকে নারীরাও মানব জাতির পরিপূর্র্ণ অংশ। মানুষ হিসেবে যেমন তাদের দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে, নারী হিসেবেও তাদের বিশেষ দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষিত রয়েছে। তবে প্রাক-ইসলামী যুগে তাদের মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন ছিল না।
নারী হিসেবেও ছিল না তাদের অধিকার ও মর্যাদা। আরবে কন্যা সন্তানকে অশুভ ও অপমানের কারণ মনে করা হতো। এ অপমান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা তাদের কন্যা-সন্তানকে জ্যান্ত কবরস্থ করতেও কুন্ঠাবোধ করতো না। শুধু আরব সমাজে নয়, বিশ্বের সব ধর্ম ও জাতির কাছে নারীর অবস্থান ছিল অমর্যাদাকর। কেউ তাদেরকে অবিত্রতার কারণ,

কেউ দুর্ভাগ্যের কারণ, আবার কেউ তাদেরকে পাপের উৎস মনে করত। সপ্তদশ শতাব্দীতে রোম শহরে অনুষ্ঠিত “কাউন্সিল অব দ্যা ওয়াইজ” (ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ঃযব রিংব) এ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ডড়সধহ যধং হড় ংড়ঁষ “নারীর কোন আত্মা নেই”। নারী সম্পর্কে প্রাক ইসলামী যুগের বিশ্বাস ও তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ চিত্রিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। বলা হয়েছে, “তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের (জন্মের) খবর দেয়া হয়, তখন তাদের চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে।
কন্যাসন্তান হওয়ার গ্লানিতে লোকসমাজ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। ভাবতে থাকে, অপমান সহ্য করে সে ওকে লালন করবে, না জীবিত মাটিচাপা দেবে! ওহ, তাদের ফয়সালা কত না জঘন্য” (সূরা আন-নাহাল: ৫৯-৬০)। আরো বলা হয়েছে, “যখন জীবন্ত কবর দেয়া শিশুকন্যাকে জিজ্ঞেসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল” (সূরা তাকভীর: ৮-৯)। ইসলাম নারী সমাজকে এমন নাজুক অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছে। তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। তাদেরকে অধিষ্ঠিত করেছে যথাযথ মর্যাদার আসনে।

পবিত্র কুরআনে তাদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে বহু আয়াত। আল্লাহর নবি (দ.) সেগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন। অথচ বুঝার অথবা বুঝানোর দুর্বলতার কারণে নারী অধিকারের বিষয়ে এক শ্রেণির মানুষের নিকট ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এর যথাযথ আলোচনা ও গবেষণা প্রয়োজন।
মানবাধিকারের পাশাপাশি নারী হিসেবে যা কিছু বিশেষ অধিকার রয়েছে, সেগুলোকে নারী অধিকার। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের ঐঁসধহ জরমযঃং, ছঁবংঃরড়হং ধহফ অহংবিৎং-এ বলা হয়েছে, “সাধারণভাবে এমন কতগুলো অধিকার হলো মানবাধিকার; যা প্রকৃগতভাবেই আমরা লাভ করে থাকি এবং যা ছাড়া আমরা মানবীয় প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকতে পারি না।”
সুতরাং প্রকৃগতভাবে নারীরা যা কিছু লাভ করে এবং যা ছাড়া নারীজীবন অচল সেগুলোকে নারী অধিকার বলা যায়। অথবা এভাবেও বলা যায় যে, নারী হিসেবে তাদের যে বিশেষ অধিকার যেমন মাতৃত্ব, মাহার ইত্যাদি নারী অধিকার। তাদের অধিকার বুঝতে হলে প্রথমে তাদের শ্রেণি বুঝতে হবে। তাদেরকে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা, এক. অবিবাহিতা, দুই. বিবাহিত তিন. বিধবা চার. পোষ্য এবং পাঁচ. অসহায়। উল্লেখিত প্রত্যেক শ্রেণির নারীর নির্দিষ্ট অধিকার পুরুষের সাথে সম্পৃক্ত। সংশ্লিষ্ট পুরুষ ব্যক্তিকে সে অধিকার প্রদান করতে হয়। যেমন, জন্মের পর থেকে বিবাহ অবধি একজন পিতা তার কন্যা সন্তানের অধিকার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি পূরণ করবে। এগুলো পিতার আবশ্যকীয় দায়িত্ব। এর বিনিময়ে পিতার জন্য রয়েছে পরকালীন পুরস্কার। বলা হয়েছে, “কোন মুসলমান যদি প্রতিদানের আশায় তার পরিবারের জন্য খরচ করে তাহলে সেটি তার পক্ষ থেকে ছাদকা হিসেবে বিবেচিত হবে (ছহিহ বুখারি-মুসলিম)।

এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, “যে ব্যাক্তি দু’টি কন্যা সন্তানকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে কিয়ামতের দিন আমি (নবি) ও সে এক সাথে থাকবো” (ছহিহ মুসলিম)। বিবাহোত্তর নারী তার স্বামীর নিকট অধিকার প্রাপ্ত হবে। স্বামীকে দাম্পত্য জীবনের চাহিদাসহ তার স্ত্রীর সব মৌলিক অধিকার পূরণ করতে হবে। এসব অধিকার প্রদানের শর্তে একজন স্বামী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। স্বামীর পক্ষে যদ্দুর সম্ভব তা আদায় করতে হবে। কোন ছল-চাতুরীর বা কুটকৌশলের আশ্রয় নেয়া যাবে না। বলা হয়েছে, “তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সুন্দরভাবে জীবন-যাপন কর” (সূরা নিসা: ১৯)। আরো বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে সে উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম” (তিরমিযি)। কোন মহিলার স্বামী যদি মারা যায় অথবা তালাকপ্রাপ্ত হয় তাহলে তার দায়িত্ব তার পিতার ওপর বর্তাবে, যদি তার কোন উপযুক্ত ছেলে সন্তান না থাকে। আল্লাহর নবি (দ.) বলেন, “সর্বোত্তম দান হলো, তোমার বিধবা কন্যার জন্য ব্যয় করা, যার কোন উপার্জনকারী নেই” (ইবন মাজাহ)। পোষ্য নারী বলতে এখানে সন্তান কর্তৃক পোষ্যকে বুঝানো হয়েছে।
অর্থাৎ যে নারী বিধবা হয়েছে অথবা যার স্বামী উপার্জনাক্ষম তার যদি উপযুক্ত ছেলে থাকে তাহলে ঐ পুত্রসন্তান মায়ের ভরণ-পোষণের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে।
এটি ছেলের ওপর ফরজ এবং কুরআন-সুন্নাহতে বার বার উচ্চারিত ‘ইহসান’ বা তাদের প্রতি সদাচারণের অন্তর্ভুক্ত। বলা হয়েছে, “তোমরা পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করবে” (সূরা বানি ইসরাঈল: ২৩)। উল্লেখিত চার শ্রেণির নারী ব্যতিত বাকিরা অসহায় নারী, যদি তাদের স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি অথবা ব্যবসা বা কোন চাকুরী না থাকে। অথবা অন্য কোন বৈধ আয়ের উৎস না থাকে। এমন নারীর দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। বলা হয়েছে, “যদি কোন মুমিন সম্পদ রেখে মারা যায় তাহলে তার ওয়ারিশগণ তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির মালিক হবে। আর যদি সে ঋণ বা অসহায় কাউকে রেখে যায় তাহলে তার দায়িত্ব আমার” (ছহিহ বুখারি)।
প্রত্যেক নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পুরুষের ওপর বর্তালেও ইসলাম নারীর স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অধিকারও দিয়েছে। সম্পদের মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের জন্য কোন বাধা নেই। বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের মালিকানা তো আছেই। উপরন্তু ব্যবসা, চাকুরী, চাষাবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে উপার্জনের অধিকার দেয়া হয়েছে তাদেরকে। এ প্রসঙ্গে বলা হেয়েছে, “পুরুষরা যা উপার্জন করবে তারাই তার মালিক, আর নারীরা যা উপার্জন করবে তারাই তার মালিক” (সূরা নিসা: ৩২)। নারীর সম্পদের উৎসগুলো হলো, এক. মাহর বাবৎ প্রাপ্ত সম্পদ। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিনিময়ে স্বামীর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সম্পদই মাহর। এ সম্পদ একান্ত তার। স্বেচ্ছায় না দিলে কেউ তা ব্যয় বা ভোগ করতে পারবে না।
তার স্বামীও তার অমতে ব্যয় বা ভোগ করতে পারবে না। যদি মাহর প্রদান করা না হয় অথবা বাকিতে স্ত্রীর সম্মতি না থাকে তাহলে স্বামীর জন্য তার স্ত্রী বৈধ হবে না। স্ত্রী যদি বাকিতে সম্মতি দেয় তাহলে আদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হবে। ইত্যবসরে যদি স্বামী মারা যায় অর্থাৎ মাহর আদায় না করে কোন স্বামী মারা গেলে তার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে তা পরিশোধ করা হবে (হেদায়া)। দুই. উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ।

পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয় ও স্বামী থেকে নারীরা মিরাস পাবে। পুরুষরা যেমন পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয় থেকে সম্পদের অংশ পাবে তেমনি নারীরাও পাবে। তবে আত্মীয়তার ঘনিষ্টতার ভিত্তিতে কেউ বেশি আবার কেউ কম পাবে। বলা হয়েছে, “পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে যাবে তার অংশ রয়েছে পুরুষের জন্য আর পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে যাবে তার অংশ পাবে নারীরাও; সেটা কম হোক বা বেশি” (সূরা নিসা: ৭)। এক্ষেত্রে একটি বিধান হলো নারী উত্তারাধিকারীর যদি ভাই থাকে তাহলে সে ভাইয়ের অর্ধেকাংশ পাবে। বলা হয়েছে, “একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান (সূরা নিসা: ১১)।” এ বিধানের ব্যাপারে কেউ কেউ আপত্তি করে থাকে। অথচ ইসলাম নারীদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব দিয়েছে অনেক কম, পুরুষদের ওপর দিয়েছে বেশি। এ বিবেচনায় উল্লেখিত নীতি কোনভাবে বৈষম্যমূলক বলা যায় না।
অন্যান্য বিধান ও বাস্তবতার নিরিখে এমন অভিযোগ ধোপে টেকে না। যেমন, ক. নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পুরুষের ওপর দেয়া হয়েছে, কিন্তু পুরুষের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তাদেরকে দেয়া হয়নি। খ. পিতা মারা যাওয়ার পর পরিবারের অন্যান্য উপযুক্ত ও অনুপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পুরুষকে, নারীকে দেয়া হয়নি। এমনকি পিতার অনুপস্থিতিতে উক্ত নারীর দায়িত্বও দেয়া হয়েছে তার ভাইকে। গ. পিতার বংশ রক্ষা করা পুত্র সন্তনের দায়িত্ব; কন্যা সন্তানকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

ঘ. পুরুষের যেমনি বিবাহ প্রয়োজন, নারীরও প্রয়োজন। বিবাহের মাধ্যমে পুরুষ যেমন পারিবারিক বা সামাজিক সুবিধা ভোগ করে নারীও তাই করে। অথচ বিবাহের জন্য নারীকে কোন মাহর দিতে হয় না। ঙ. সংসার জীবনে সাধারণত নারীর তেমন খরচ নেই, কিন্ত পুরুষের খরচ বহুমুখী। তাই ভাইয়ের তুলনায় বোনের অংশ কম হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। তিন. পেশাগত উপার্জন- ইসলাম ধর্মে নারীকে পেশাগত জীবন থেকে বাধা প্রদান করা হয়নি, যদিও ঘরের নেতৃত্ব ও দায়িত্বের প্রয়োজনে পেশাগত জীবনের প্রতি উৎসাহিত করা হয়নি। হযরত খাদিজা (র.) ছিলেন বড় ব্যবসায়ী । তাঁর আর্থিক সুদৃঢ় অবস্থানের কারণে ইসলামের প্রসার লাভ করেছে। তাঁর অবদানের কথা আল্লাহর নবি (দ.) সদা স্মরণ করতেন।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট