চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

রক্তাক্ত পাহাড়, নিহত ৫

মাটিরাঙ্গায় বিজিবি-গ্রামবাসী সংঘর্ষ নিহতের মধ্যে একজন বিজিবি সদস্য, পিতাপুত্রসহ একই পরিবারের ৩ জন, অপরজন গ্রামবাসী ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি ‘দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে’ তদন্ত শেষে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে : বিজিবি

নিজস্ব সংবাদদাতা, খাগড়াছড়ি/রামগড়

৪ মার্চ, ২০২০ | ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে বিজিবি সদস্য ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে এক বিজিবি সদস্য এবং একই পরিবারের তিনজনসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। স্বামী ও দুই সন্তান নিহতের খবর শুনে মারা গেছেন এক গৃহিনী। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশের পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনীও টহলে নেমেছে।

মঙ্গলবার (গতকাল) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাটিরাঙ্গা উপজেলার গাজিনগর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন, ৪০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সিপাহী মো. শাওন (৩৫), আলুটিলা বটতলী গ্রামের সাহাব মিয়া (৭০), তার ছেলে মো. আলী আকবর (৩০) ও মো. আহাম্মদ আলী (৩০)। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মো. মফিজ মিয়া (৫০) মারা যান। এদিকে বিজিবির গুলিতে স্বামী ও দুই সন্তান নিহতের খবর শুনে আলুটিলা বটতলীর নিজ বাড়িতে সাহাব মিয়ার স্ত্রী রঞ্জু বেগম মারা যান।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার ( গতকাল) বেলা ১১টার দিকে বৈদ্যুতিক তার টানার জন্য কয়েকটি গাছ কাটা হয়। এসময় একটি ট্রাক্টরে করে সাহাব মিয়া ও তার ছেলে আহাম্মদ আলী কয়েক টুকরো গাছ গাজিনগর বাজারের একটি কাঠের ‘স’ মিলে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেয় বিজিবি। বিজিবি কাঠগুলো জব্দ করে নিয়ে যেতে চাইলে তারা ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানান। কিন্তু বিজিবি কোন কথা না শুনে জোর করে নিয়ে যেতে চায়। এ অবস্থায় পিতা ও ছেলে বিজিবির সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে বিজিবি’র সাথে বাকবিত-ায় লিপ্ত হয়। এতে মুহূর্তে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়, পরে তা সংঘর্ষে রুপ নেয়। এসময় বিজিবি সদস্যরা গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে ঘটনা স্থলেই মারা যান সাহাব মিয়া ও তার ছেলে মো. আকবর আলী। এসময় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিজিবি সদস্য শাওন, স্থানীয় আহাম্মদ আলী, মফিজ মিয়া এবং মো. হানিফ মিয়াকে মাটিরাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে সেখানেই মারা যায় বিজিবি সদস্য শাওন ও আহাম্মদ আলী। বিজিবি সদস্য শাওন কিভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন তথ্য কেউ জানাতে পারেনি।

এদিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান মো. মফিজ মিয়া।
মাটিরাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামছুদ্দিন ভুঁইয়া সংঘর্ষে ছয় জন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এ ঘটনায় নিহত বিজিবি সদস্যসহ দু’জনের মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। অন্য দু’জনের মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে স্বামী ও দুই সন্তান নিহতের খবরে মারা গেছেন সাহাব মিয়ার স্ত্রী রঞ্জু বেগম। এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। তবে এ বিষয়ে বিজিবিরি পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে ঘটনার পর বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহরিয়ার জামান, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস, খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আব্দুল আজিজ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম.এম সারাহ উদ্দিন, মাটিরাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম, মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিভীষণ কান্তি দাশ, মাটিরাঙ্গা পৌরসভার মেয়র মো. শামছুল হক ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম হুমায়ুন মোরশেদ খান।
এসময় স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহরিয়ার জামান ও খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস।

জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, এ ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তার প্রতিনিধিকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলেও জেলা প্রশাসক জানান। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এসময় তিনি সকলকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান।
এ ঘটনায় জড়িত দোষীদের বিচারের আওতায় আনা হবে জানিয়ে সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহরিয়ার জামান সকলকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিষয়টি ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। এসময় স্থানীয়রা বিজিবি ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি জানালে তিনি বলেন, গুটি কয়েক খারাপ লোকের জন্য একটি বাহিনীকে দোষারোপ করা যাবে না।
বিজিবি’র বক্তব্য :

মাটিরাঙ্গার ঘটনায় বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কমকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার গাজীনগর বাজার হতে ১০০ গজ দক্ষিণে বিজিবি’র একটি টহল দল অবৈধ কাঠ পাচাররোধে ব্যবস্থা নিলে বেসামরিক স্থানীয় লোকজন বিজিবি টহল দলকে ঘিরে ধরে। এতে বিজিবি টহল দল ও বেসামরিক জনগণের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, বিজিবি’র এক রাউন্ড ফাঁকা ফায়ার ও ধাক্কাধাক্কির রেশ ধরে একপর্যায়ে বেসামরিক লোকজন বিজিবি’র অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গুলি বর্ষণ করে। আলোচ্য ঘটনায় বিজিবি’র সিপাহী শাওন ও ৫ জন বেসামরিক জনগণের গায়ে গুলি লাগে। এতে বিজিবি সদস্য শাওন ও বেসামরিক ৪ জন মৃত্যুবরণ করে। এতদপ্রেক্ষিতে বিজিবি’র গুইমারা সেক্টর কমান্ডার, সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আলোচ্য ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁরা পৃথকভাবে ঘটনা তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেছেন। সামগ্রিক ঘটনাটি তদন্ত শেষে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট