চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হোটেলগুলো অনৈতিক কাজের আখড়া

আয়তন : ১ বর্গ কিলোমিটার জনসংখ্যা : ১ লাখ ১০ হাজার ভোটার : ২১ হাজার ৫৫৫ জন

আল- আমিন সিকদার

২ মার্চ, ২০২০ | ২:৩২ পূর্বাহ্ণ

১৬শ শতকের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা। পর্তুগিজরা এ-অঞ্চলে ‘ফিরিঙ্গি’ নামে পরিচিত ছিলো। ১৫৩৭ সালের দিকে শেরশাহের আক্রমণে ভীত হয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে পর্তুগিজদের চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক আদায়ের অধিকার প্রদান করেন। এতে পর্তুগিজরা দেয়াং বাণিজ্য কুঠি এবং গির্জা নির্মাণ করার পাশাপাশি পণ্য সামগ্রীর আড়ত স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এলাকাটি ফিরিঙ্গিদের নামানুসারে ওই বাজারটি ‘ফিরিঙ্গি বাজার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি এখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড।

এই ফিরিঙ্গি বাজারটি নগরীতে এখন পরিচিত কলার আড়ত হিসেবে। একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এ বাজারটি এখন এই ওয়ার্ডের সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্জ্য অপসারণে অব্যবস্থাপনার কারণে এই বাজারের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আবর্জনা। অভিযোগ রয়েছে, এই বাজারের পাশ ঘিরে যেসব হোটেল গড়ে ওঠেছে তার অধিকাংশতেই চলে জুয়া ও অনৈতিক কার্যকলাপ। আছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কর্ণফুলীর পাড় দখল নেয়ার অভিযোগও।

এছাড়াও ওয়ার্ড ঘুরে তুলে এনেছি এখনকার সড়কের বেহাল দশার চিত্রও। ওয়ার্ডটিতে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএর আঞ্চলিক সদর দপ্তর। আর এ দপ্তরের সামনের রাস্তাটিই ভাঙা আর কাদামাটিতে একাকার। অন্যদিকে মাদকের অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত অভয়মিত্র ব্রিজ ঘাট। সন্ধ্যা হলেই বিভিন্ন বয়সের মাদকসেবীরা এটাকে নিরাপদ মাদক সেবনের আস্তানা বানিয়ে ফেলেন। তাইতো স্থানীয়রা এসব অভিযোগ যেমন আমাদের কাছে জানিয়েছেন তেমনি চেয়েছেন সমাধান।
ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. ফারুক আহমেদ। জন্মসূত্রে এই ওয়ার্ডে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করছেন তিনি। পূর্বকোণকে জানিয়েছেন নিজ এলাকার দৃশ্যমান সমস্যাগুলো। তিনি বলেন, ‘ধুলাবালির কারণে আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া রাস্তায় কাদা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। আর ওয়াসার পানির সমস্যাও আমাদের এলাকায় রয়েছে। ভবিষ্যৎ কাউন্সিলরের কাছে এসব সমস্যার সমাধান কামনা করছি’।

অত্র এলাকার ব্যবসায়ী নারায়ণ দাশ বলেন, ‘আমাদের এলাকার রাস্তাগুলো সবসময়ই অপরিষ্কার থাকে। ১৫-২০ দিনেও পরিচ্ছন্ন কর্মী আসে না। ধুলাবালির জন্য আমরা বিরক্তি হয়ে গেছি। শুধু তাই নয়, রাস্তা দখল করে ফেলার কারণে আমাদের চলাফেরা করতে খুবই সমস্যা হয়। বৃষ্টির সময় কাদার কারণে আমরা হাটা-চলা করতে পারি না। আর যে রাস্তা আছে তার বেশির ভাগই দখলে চলে গেছে’।

ওয়ার্ডটিতে উল্লেখযোগ্য স্থপনার মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টান উপাসনালয়, জেএম সেন স্কুল এন্ড কলেজ, কর্ণফুলী মেরিনার্স পার্ক। রয়েছে ঐতিহ্যবাহী অভয়মিত্র খেয়া ঘাট ও দাম্মা পুকুর পাড়। অবশ্য দাম্মা পুকুর নাম থাকলেও এখন সেখানে পুকুরটি আর নেই। এটি বাচ্চাদের খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও এই ওয়ার্ডটিতে রয়েছে জেলেদের বিশাল একটি অংশ। তাইতো এখানের কর্ণফুলীর পাড়ে গেলে দেখা মিলে সারিবদ্ধভাবে নোঙর ফেলা মৎস্য ট্রলারগুলোর।
মাদক আর বর্জ্য অপসারণে ব্যর্থ হওয়ার কারণ জানতে আমরা মুখোমুখি হয়েছি বর্তমান কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লবের। জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিষয়টি কিছুটা স্বীকারও করেছেন তিনি। হোটেলের জুয়া ও অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন তিনি।
তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ৪১টি ওয়ার্ডে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ২০-২৫ জনের একটি তালিকা তৈরি করে আমরা পুলিশ প্রশাসনকে দিয়েছি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। আর বিভিন্ন কায়দায় মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের মাদক চালান এবং সেবন করে যার কারণে সম্পূর্ণভাবে মাদক নির্মূল করা সম্ভব হয় না। তবে মাদকের প্রভাব আমরা বিগত সময় থেকে অনেক কমিয়ে আনতে পেরেছি’।

হোটেলগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এই ধরনের অন্যায় কাজকে কখনোই সমর্থন করি না। আমার কাছে এখন পর্যন্ত এরকম কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে এই ধরনের অভিযোগ যদি কেউ আমাকে করে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি প্রশাসনকে সাথে নিয়ে এর সমাধানে কাজ করবো’।

সুপেয় পানির ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে সাজিপাড়ার বাসিন্দারা কিছু দিন অপরিষ্কার পানি পেয়েছিল যা ওয়াসা থেকে ঠিক করে দেয়া হয়েছে। বলতে গেলে শতভাগ ওয়াসার সংযোগ আমি আমার ওয়ার্ডে নিশ্চিত করেছি’।
ব্রিজঘাট রোডের বেহাল দশার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের মাটিগুলো ওভার লোড করে ড্রাম ট্রাকের মাধ্যমে এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যার কারণে কাদাগুলো রাস্তায় পড়ে এই অবস্থা হয়েছে। আমি তাদেরকে বহুবার অনুরোধ করেছি সুরক্ষিত ভাবে এই মাটি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তবে তারা আমার কোনো কথাই শুনেনি। আমি আশা করবো কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে’।
জানতে চেয়েছিলাম ওয়ার্ডের উন্নয়নে কি কি করেছেন। উত্তরে তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ পেয়েছি, ইতিমধ্যে ৪০ কোটি টাকার কাজ শেষ করেছি। সমাপ্ত কাজের মধ্যে রয়েছে ১৫টি সড়কের সংস্কার কাজ, ২০টি নালা নির্মাণ ও নালাতে স্ল্যাব স্থাপন, জাকির হোসেন হোমিওপ্যাথি কলেজের ৬ তলা ভবন নির্মাণসহ ওয়ার্ডের বিভিন্ন সৌন্দর্য বর্ধন করেছি। আর এডিবির বরাদ্দে ৬০কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে এয়াকুব আলী দোভাষ স্কুলের নির্মাণ কাজ এবং ১টি সড়কের সংস্কার কাজ। পাশাপাশি আলকরণ সুলতান আহমদ সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয় ও জেএমসেন স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া সেবক কলোনিতে ৩২ কেটি টাকা ব্যায়ে একটি আধুনিক ভবন হবে যার টেন্ডার ইতিমধ্যে হয়ে গেছে’।
এদিকে নানান বির্তকের কারণে দলের সমর্থন পায়নি মহানগর যুবলীগ আহ্বায়ক কমিটির সিনিয়র সদস্য হাসান মুরাদ বিপ্লব। তবে দলের সমর্থন না পেলেও মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হয়ে লড়বেন মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. সালাউদ্দীন। বিএনপির হয়ে লড়বেন ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান।

এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আরও মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত মো. মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী মিন্টু ও চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য এডভোকেট এইচ এম হোসাইনুর রশীদ।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মো. সালাউদ্দীন জানান, ওয়ার্ডের সার্বিক উন্নয়নে তিনি ৫টি বিষয়কে প্রাধান্য দিবেন। এগুলো হলো- এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নিয়মিত নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থার পরিকল্পিত উন্নয়ন করা, মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে কাজ করা, মাদক থেকে রক্ষার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের  সাথে যুবকদের জড়িত রাখা ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মাধ্যমে ঠিকমতো আবর্জনা অপসারণ ও ধুলাবালির সমস্যার সমাধানে কাজ করা।
বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী সাদেকুর রহমান নির্বাচিত হলে এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করা, সুপেয় পানির অভাব মেটাতে ওয়াসার সাথে সমন্বয় করে কাজ করা এবং যানজট সমস্যার সমাধানে ট্রাফিক বিভাগের সাথে মিলে কাজ করার আশা ব্যক্ত করেছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট