চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

গার্মেন্টস খাত বাঁচাতে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা ­

গার্মেন্টসের জন্য আলাদা ব্যাংক আইন ­হ ‘অযৌক্তিক’ পণ্য আটক শিথিল করা ­হ প্রণোদনা ৫% উন্নীতকরণ ­হ পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম শিথিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

১ মার্চ, ২০২০ | ৩:০৮ পূর্বাহ্ণ

বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত গার্মেন্টস খাতে নতুন আপদ হয়ে এসেছে করোনা ভাইরাস। এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে দেশে গত এক বছরে নীট ও ওভেন পোশাকের কারখানা বন্ধ হয়েছে ১৪৩টি। কর্মচ্যুত হয়েছে ৭৩ হাজার পোশাককর্মী। বিনিয়োগও বাড়ছে না এই খাতে। উদ্ভূত এমন পরিস্থিতির মধ্যে বেড়েছে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের দাম। সাথে ব্যাংকের ঋণের চাপ পোশাক শিল্পখাতকে ভয়ানক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাচ্ছে।

উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস রপ্তানিকারকরা গতকাল শনিবার এক জরুরি মতবিনিময় সভায় বসেন। প্রায় সকলেরই কপালে চিন্তার ভাঁজ কয়েক মাসের মধ্যে পোশাক শিল্প কর্মীদের ঈদ বোনাস ও বেতন ভাতা কিভাবে দেয়া সম্ভব হবে। এদিকে, করোনা ভাইরাসের কারণে গত দুই মাসে কোন ব্যবসাই হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার থেকে কোন ফান্ড পাওয়া না গেলে ঈদ বোনাস ও বেতন ভাতা দেয়া সম্ভব হবে না। গার্মেন্টস খাতকে মুমূর্ষু অবস্থা থেকে বাঁচাতে মালিকরা শুধু গার্মেন্টস খাতের জন্য আলাদা ব্যাংক আইনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বলেছেন, গার্মেন্টস খাতকে বাঁচাতে হলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের উপর ঋণের চাপ কমাতে হবে। কাঁচামাল আমদানিতে বন্ড কমিশনারেটের অযৌক্তিক পণ্য আটক শিথিল করতে হবে। সরকার গার্মেন্টস খাতের জন্য বিদ্যমান প্রণোদনা ১ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করতে হবে। তবেই হয়তো গার্মেন্টস খাত বাঁচার পথ খুঁজে পাবে।

গার্মেন্টস শিল্পে বিশ্বমন্দা অবস্থা চলছে উল্লেখ করে বলেন, এমনিতে বিশ্ব মন্দা তদুপরি প্রতিযোগিতার মুখে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে হাঁটছে। গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা দিলেও চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের শুরু থেকেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (-৫.৭১%) এই শিল্পকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারখানার সংস্কারে প্রচুর ব্যয় হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সে অনুপাতে পোশাকের মূল্য বৃদ্ধি না হওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সরকার এই শিল্পকে বাঁচাতে ইনসেনটিভ দিচ্ছেন এবং উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ করেছেন। কিন্তু এতে তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দাবি ছিল রপ্তানীমুখী পোশাক শিল্পের জন্য ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার মূল্যমান কমপক্ষে ৫/- টাকা কমানো।
ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে চলছে মন্দাবস্থা। এমন মন্তব্য করে আলোচনায় বক্তারা বলেন, পোশাক রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপিয় ইউনিয়ন। আমাদের তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশ রপ্তানি হয় সেখানে। সম্প্রতি সেখানেও রপ্তানি বাজার কমে গেছে। ইইউতে ১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। সেসব দেশে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ায় পোশাকের চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ইউরোপিয় ইউনিয়নে রপ্তানিকারক শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে চীনের পরেই বাংলাদেশ। সম্প্রতিককালে সেখানে চীনের রপ্তানি ব্যাপকহারে কমে যাওয়ার সুবিধা নিয়েছে ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, শ্রীলংকা। বাংলাদেশ সে সুযোগ নিতে পারেনি। পাশাপাশি ভিয়েতনামের সাথে এফটিএ চুক্তি করেছে ইইউ। যার প্রভাব আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে আরো প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়েছে।

করোনা ভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বক্তারা বলেন, সম্প্রতি চীনে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি- মরার উপর খাড়ার খাঁয়ের মত অবস্থা গার্মেন্টস শিল্পের। চীন থেকে ফেব্রিকসহ কাঁচামাল আমদানি বন্ধ রয়েছে। চীন থেকে বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্য, পোশাক শিল্পের কাঁচামালসহ আমদানি করে প্রায় ১৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। আমদানিকৃত পণ্যের প্রায় ৩৭ শতাংশ গার্মেন্টস শিল্প সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল ও মেশিনারি। এসবের জন্য চীনের বিকল্প আমাদের হাতে নেই। পাকিস্তান বা কোরিয়া থেকে কাপড় বা কাঁচামাল এনে তৈরি পোশাকের মূল্য দ্বিগুণের বেশি পড়বে। এছাড়া মার্চের মধ্যে চায়না থেকে আমদানি স্বাভাবিক না হলে কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক কারখানা লীড টাইমের মধ্যে রপ্তানি করতে পারবে না।
এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আপদকালীন তহবিল, ঋণের নিশ্চয়তা স্কিম ও ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের নীতিমালায় সংশোধনসহ তিনটি সুবিধা চাওয়া হয়েছে। যাতে বিকল্প উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এপ্রিলের মধ্যে অনেক গার্মেন্টসের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। আসন্ন রোজা ও ঈদের বেতন বোনাস নিয়ে বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ারও শংঙ্কা রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে কিছু কিছু বায়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু কাঁচামাল সংকটে তা আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।

বক্তারা আরো বলেন, এমন সংকটের মধ্যেও ভাল খবর হলো চীনে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় কারখানাগুলোতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে চীনের ৫টি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরমুখি পণ্য জাহাজীকরণ শুরু হয়েছে। আশা করা যায় আগামী মাসের প্রথম দিকেই কাঁচামাল পাওয়া যাবে। তবে বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জাহাজগুলো বন্দরে পৌঁছার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিজিএমইএর সভা : পোশাক শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শনিবার বিকেলে বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম এর সভাপতিত্বে বিজিএমইএ’র আঞ্চলিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন বিজিএমইএ’র প্রাক্তন সভাপতি এসএম ফজলুল হক, প্রাক্তন প্রথম সহ-সভাপতি আলহাজ খলিলুর রহমান, নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, মঈনুদ্দিন আহমেদ (মিন্টু), প্রাক্তন পরিচালক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী ও সেলিম রহমান, বিজিএমইএ’র সদস্য মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এফসিএমএ, চৌধুরী নাঈম রহমান ও শওকত ওসমান।
আলোচনা সভায় বক্তারা সমসাময়িক পোশাক শিল্প পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন এবং গার্মেন্টস খাতকে বাঁচাতে বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। আলোচনায় বক্তারা উপস্থাপিত প্রস্তাবনাগুলো সরকারি সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিত করবেন। তারা আশা করেন এখনই ব্যবস্থা নেয়া হলে গার্মেন্টস খাতকে বাঁচানো সম্ভব।
সভায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন- বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি এএম চৌধুরী সেলিম, পরিচালকবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ মুসা, অঞ্জন শেখর দাশ, মোহাম্মদ আতিক, খন্দকার বেলায়েত হোসেন, এনামূল আজিজ চৌধুরী। আরো ছিলেন প্রাক্তন সভাপতি এসএম ফজলুল হক, প্রাক্তন প্রথম সহ-সভাপতি আলহাজ খলিলুর রহমান, নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, মঈনুদ্দিন আহমেদ (মিন্টু), প্রাক্তন সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ফেরদৌস, প্রাক্তন পরিচালকবৃন্দ মধ্যে ছিলেন একেএম ছালেহ উদ্দিন, সাজেদুল ইসলাম, হেলাল উদ্দিন চৌধুরী, এমদাদুল হক চৌধুরী, আ.ন.ম. সাইফুদ্দিন, কাজী মাহবুব উদ্দিন জুয়েল, নাফিদ নবী, সেলিম রহমান, আমজাদ হোসেন চৌধুরীসহ পোশাক শিল্পের মালিকবৃন্দ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট