চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

কারাবন্দীর হাত এখন কর্মীর হাত
কারাবন্দীর হাত এখন কর্মীর হাত

কারাবন্দীর হাত এখন কর্মীর হাত

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার ষ কারাগারে তৈরি পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে ষ চিহ্নিত অপরাধী ও মাদকাসক্তদের মানসিক বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণ করার ব্যবস্থাও আছে নাজিম মুহাম্মদ হকারাবন্দীর হাত এখন কর্মীর হাত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার ষ কারাগারে তৈরি পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে ষ চিহ্নিত অপরাধী ও মাদকাসক্তদের মানসিক বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণ করার ব্যবস্থাও আছে

নাজিম মুহাম্মদ

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

বন্দীর হাত হতে যাচ্ছে কর্মীর হাত। বন্দীদের আলোর পথ দেখাচ্ছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। এ পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ কয়েদিদের জীবনেও। মনোনিবেশ করছেন উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কাজে। কাজের বিনিময়ে পাচ্ছেন সম্মানী। এ কারণে বন্দীদের আগ্রহ বাড়ছে কাজের প্রতি। সারাদিন কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে কয়েদি বন্দীদের। তাদের উৎপাদিত পণ্যের লভ্যাংশ পেয়ে কেউ কেউ পরিবারের জন্যও টাকা পাঠাতে পারছেন। সব মিলিয়ে কারাভোগের ভেতর থেকেই নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখছে কারাবন্দী নাঈমা আক্তার, নিগার সুলতানা, সুইটি

আক্তার। কারাগার মানেই বন্দীদের কারা প্রকোষ্ঠে আটকে রাখার ধারণা পাল্টে দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারে তৈরি পণ্য ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। লেখাপড়া না জানা বন্দীদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি গণশিক্ষা কার্যক্রমও আছে। চিহ্নিত অপরাধী ও মাদকাসক্তদের মানসিক বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণ করার ব্যবস্থাও আছে। প্রশিক্ষণ ছাড়া সুস্থ মনোবিকাশের জন্য রয়েছে বিনোদনমূলক সংস্কৃতি ও খেলাধুলার ব্যবস্থাও। এসব বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে কয়েদিরা সুস্থ জীবনে ফিরে এসে আলোর পথে পা বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের কুটিরশিল্প, ইলেক্ট্রনিফলে রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ স্লোগানটি যথাযথই বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ।ক সামগ্রী মেরামত প্রশিক্ষণ, জুতা তৈরি, বুটিকের তৈরি থ্রিপিস, কাঠের তৈরি বিভিন্ন শো-পিসসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে বন্দীদের নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই দেওয়া হচ্ছে বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ। কয়েদি পুরুষ ও মহিলাদের তাঁত, রান্না, সেলাই, ইলেক্ট্রিকএন্ড হাউস ওয়্যারিং, নার্সারি, বিউটি পার্লার ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন কাজ শেখানো হচ্ছে। এ প্রশিক্ষণ নিয়ে কারাবন্দী রাজু, মো. জুয়েল, সামছু মিয়া ও আমির হোসেনরা কাঠ, বেত, বাঁশ, তাঁত, সুতা ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে তৈরি করছে ছোট-বড় মোড়া, চেয়ার, ঝুড়ি, ও বেতের ঝুড়িসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ব্যবহার সামগ্রী। যার ফলে কয়েদিরা মুক্ত হওয়ার পরও যাতে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। মূলত কয়েদিদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও মানসিক বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে বন্দীদের জীবনমান বদলে দেয়ার জন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। প্রতিফলন হিসেবে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েদিরা নিপুণ কারিগর হয়ে উঠছেন। তৈরি করছেন বাঁশ, বেত ও কাঠের দৃষ্টিনন্দন বাহারি আসবাব ও গৃহসামগ্রী।

জানাযায়, ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় দেশের ৩২ কারাগারের দুইশোর মতো পণ্য প্যাভিলিয়নে বিক্রি করা হয়েছে। এবারের বাণিজ্য মেলায় সবচেয়ে বেশি পণ্য গেছে চট্টগ্রাম, যশোর ও কাশিমপুর কারাগার থেকে। চট্টগ্রাম কারাগারের বন্দীদের তৈরি প্রতি জোড়া স্যান্ডেল ৪০০ টাকা ও প্রতি জোড়া জুতা দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে বাণিজ্য মেলায়। ৮০ টাকায় তাঁতের তৈরি গামছা, ২০০ থেকে ৩৫০ টাকায় চাদর বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন সিংহাসন চেয়ার, নৌকা, বেতের মোড়া, বুটিকের থ্রিপিস, পুঁতির তৈরি মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ, কলমদানিসহ কারুকাজের নানা পণ্য। বন্দীদের তৈরি পণ্য সামগ্রী ক্রেতাদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. কামাল হোসেন জানান, এসব প্রশিক্ষিত বন্দী মুক্তি লাভের পর নতুনভাবে নিজেদের কর্মজীবন শুরুর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। সাজার মেয়াদ শেষে জামিনে মুক্তির পর যাতে সমাজ ও পরিবারের বোঝা না হয়ে একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রস্তুুত করতে পারে সে লক্ষে কারান্তরীণ বন্দীদের সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

কারা কর্তৃপক্ষের এ আয়োজনে কয়েদিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তন হবে। কয়েদিরা কেবল অপরাধী নয়, তারা সৃজনশীল কাজও করতে পারেন, তারই বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছিল এবারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়। কয়েদিদের তৈরি পণ্যের পসরা দেখে হতবাক হয়েছেন দর্শনার্থী ও ক্রেতারা। এর মাধ্যমে কয়েদিদের প্রতি এক ধরনের সহানুভূতির জন্ম নিয়েছে সাধারণ জনগণের মাঝে। চট্টগ্রাম কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কয়েদিদের হাতে তৈরি পণ্য সম্ভারে এই প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশ নিয়েছে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ। কয়েদিদের তৈরি বাহারি পণ্য তালিকায় রয়েছে পুঁতি দানার তৈরি হাত ব্যাগ, ফুলদানি, নকশিকাঁথা থেকে শুরু করে বুটিক ও বাটিকের থ্রিপিস। উৎপাদিত পণ্যের লাভের শতকরা ৫০ শতাংশ মজুরি বাবদ কারাবন্দীর মধ্যে বিতরণ করা হয় আর বাকি ৫০ শতাংশ সরকারি কোষাগারে জমা হয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট