চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

কমছে পারিবারিক বন্ধন বাড়ছে অশান্তির মাত্রা

মরিয়ম জাহান মুন্নী

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ পুলিশ অপরাধ বিভাগের তথ্য মতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ জন। আর এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে। বছরে মোট হত্যাকা-ের প্রায় ৫০ শতাংশ সংঘটিত হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে।

পারিবারিক কলহ ও সামাজিক অস্থিরতার কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে অপ্রিয় অনেক কঠিন সত্য ও নানা তথ্য। পারিবারিক কলহের প্রধান কারণ যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠন, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, অন্য দেশের সংস্কৃতির আগ্রাসন, স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা ও অতিমাত্রায় ইন্টারনেট আসক্তি। একসময় দেশে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ছিল। গ্রামে ৭০ ভাগ মানুষ আর শহরে ৩০ ভাগ মানুষ বাস করতো। পরিবারগুলো ছিল যৌথ ও কৃষি নির্ভর। প্রতিটি পরিবারে বাবা-মা, দাদা-দাদী, চাচা-ফুফুসহ অনেক সদস্য বাস করতো। সবার মধ্যে আন্তরিকতা আর ভালোবাসার বন্ধন ছিল। এমন পরিবেশে একজন মানুষ বেড়ে উঠে বহুমুখী শিক্ষা নিয়ে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই থাকে। কিন্তু একক পরিবারে এসব কিছুই দেখা যায় না। একক পরিবারে অধিকাংশ স্বামী-স্ত্রী উচ্চ শিক্ষিত এবং চাকরিজীবী হয়ে থাকে। বর্তমানে শহরে প্রায় ৮০ ভাগ একক পরিবার রয়েছে। চলতি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা ও উন্নয়নে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে চলেছে নানাদিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা ও হতাশা।

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুন, ও মারামারি। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মূল্যবোধ তথা মানুষের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়। পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া। এছাড়া অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিও আছে। পরিবার আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম মূলভিত্তি। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পারিবারিক কলহের ঘটনা ঘটছে। বেড়ে গেছে পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন। স্বামী-স্ত্রীর কলহের জেরে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুকেও। সাম্প্রতিক পারিবারিক কলহের কারণে পরিবারের সবাই একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। মানুষ এখন আপনজনের কাছেও নিরাপদ নয়।

এবিষষ সমাজ বিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, সভ্যতার উন্নয়ন ও নগরায়ন হলে এমন সমস্যা দেখা যায়। আগে মানুষ বেশি গ্রামে বাস করতো আর এখন শহরে। শিক্ষাগ্রহণের জন্য শহরমুখী হচ্ছে মানুষজন। শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারী শিক্ষার প্রসার, অতিমাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারে আসক্তি ও নারীদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধিসহ আরো কিছু কারণে পারিবারিক কলহ বাড়ছে। নারীদের উন্নয়ন যেমন একটি দেশকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করে তেমনি পারিবারিক অশান্তির কারণও হয়ে উঠে। তাই বলে নারীদের উন্নয়নই শুধু পারিবারিক কলহের কারণ বলছি না। একটি পরিবারে অশান্তির পিছনে আরো অনেক কারণ আছে। অভাব-অনটন, অর্থের প্রতি দুর্বলতা, চাওয়া পাওয়ার অসঙ্গতির কারণ, দাম্পত্য কলহ নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা, বিষন্নতা ও মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন কারণে সামাজিক অশান্তি বাড়ছে। এছাড়া বিবাহপূর্ব সম্পর্ক, বিয়ের পরে পরকীয়া, যথাসময়ে বিবাহ সম্পন্ন না হওয়া, একক সিদ্ধান্তে বিবাহ, ন্যায় বিচারের অনুপস্থিতি, নারীদের বৈচিত্র্যময় খোলামেলা উগ্র পোশাক সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে এই সামাজিক অবক্ষয় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মাদ আফজাল হোসেন বলেন, পারিবারিক কলহ কিংবা অশান্তি সামাজিক ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি, হতাশা বা দূরত্ব বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হল শারীরিক চাহিদা অপূর্ণ থাকা। আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলে জানে না, একটা মেয়েকে কীভাবে শারীরিকভাবে সুখী করতে হয়। আগে যখন কোনো বিয়ে হতো সেই সম্পর্কের দায়ভার দুই পরিবারসহ অভিভাবকরা নিত। বর্তমানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের অনেক মাধ্যম হয়েছে ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা নিজেই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পরিবার এসব বিয়েতে সম্মতি দিলেও দায়ভার নিচ্ছে না। ফলে পারিবারিক অশান্তি বা স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে মুখোমুখি দাঁড় করাতে হচ্ছে ছেলেমেয়েকে। এসবের কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পারিবারিক অনুশাসন মানার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক কলহ।

বহদ্দারহাট বাদশা চেয়ারম্যান ঘাটার এক গৃহবধূ ঝুমুরের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, পড়ালেখা শেষ করেই বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করি। বরিশাল থেকে স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামে আসি। স্বামী কাজল আহমেদ চাকরি করেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস। কিন্তু অফিসের ব্যস্ততা শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। আবার যেহেতু সকালে অফিসে যেতে হবে তাই রাতে ঘুমাতে হয় ১১টার মধ্যে। এদিকে সারা দিন বাসাতে একাই থাকতে হয়। ব্যস্ততার কারণে স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়ার সময় করতে পারেন না স্বামী। এভাবেই কেটে যায় কয়েক বছর। তিনি বলেন প্রায় সময় ইচ্ছে করে সব ছেড়ে চলে যাই আগের জীবনে। তার মতে মূলত এভাবেই পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এক শিক্ষার্থী (ছদ্মনাম) শান্তা। রূপে-গুণে অতুলনীয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অগণিত ভক্ত, ফ্যান-ফলোয়ার। এদিকে এই রূপকে কাজে লাগিয়ে একটার পর একটা প্রেম করেছে। শুধু তাই নয় একসঙ্গে কয়েকটি প্রেম করছে অনায়াসেই। তার সঙ্গে প্রেম করা ছেলেদের অনেকেই শান্তার চরিত্রের বিষয়টি জেনেও শারীরিক সঙ্গ লাভের আশায় তার রূপের জালে জড়াচ্ছেন। তার চরিত্র নিয়ে কম বেশি সবাই পেছনে কথা বলে। বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থীরা বলেন এটি সামাজিক অবক্ষয়ের আরো একটি প্রধান কারণ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট