চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ট্রলার ডুবে ১৫ রোহিঙ্গার মৃত্যু

মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন নিভে গেল সেন্টমার্টিনে, জীবিত উদ্ধার ৭২ উদ্ধার ৪৬ জনই রোহিঙ্গা নারী আটক ৪ দালাল

হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ

টেকনাফের সেন্টমার্টিনদ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি ট্রলার ডুবির ঘটনায় কোস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে মৃত ১২ জন রোহিঙ্গা নারী, ৩ জন শিশুকে উদ্ধার করেছে। এছাড়া জীবিত ভাসমান অবস্থায় ৭২ জনকে উদ্ধার করেছে। আবার অনেকে সাঁতরিয়ে উপকূলে উঠে গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানা গেছে। ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক। চোরাই পথে সাগর দিয়ে মানব পাচারে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ৭২ জনের মধ্যে ৪৬ জনই রোহিঙ্গা নারী এবং ২৬ জন পুরুষ। এসব রোহিঙ্গা নারীরা বিয়ে করার লোভে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিল।

জানা যায়, গতকাল (মঙ্গলবার) ভোরে বাহারছড়া উপকূল হয়ে ছেড়ে আসা ২টি ট্রলার অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার কারণে সেন্টমার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের অদূরে ভোররাতে ডুবোচরে আটকে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ট্রলারে থাকা মালয়েশিয়াগামী যাত্রী জনৈক আব্দু ‘৯৯৯’ নম্বরে কল করে বাঁচার আকুতি জানানোর সংবাদ পেয়ে কোস্টগার্ড সাগরে উদ্ধার অভিযানে নামে। এসময় ১টি ট্রলার ডুবে গেলেও অপর ১টি ট্রলার এবং সাগর হতে ভাসমান ১২ জন নারী, ৩ জন শিশুর মৃত দেহ এবং ৪৬ জন নারী, ২২ জন পুরুষ ও ৪ জন ছেলে-শিশুসহ ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। জীবিতদের সেন্টমার্টিন জেটিতে এনে প্রাথমিক চিকিৎসা ও শুকনো খাবার দেওয়া হয়। তাছাড়া দালাল সন্দেহে কুতুপালং ক্যাম্প সি-৩ এর বাসিন্দা আব্দুস সালামের পুত্র আজিজ (৩০), বালুখালী বি-৩ এর বাসিন্দা কবির হোসেনের পুত্র ওসমান (১৭), নোয়াখালীয়াপাড়ার হাসান আলীর পুত্র ছৈয়দ আলম (২৭) এবং একই এলাকার ফয়েজ আহমদের পুত্র উলা মিয়াকে (২৫) আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আটককৃত দালালরা জানিয়েছেন, প্রতিজন মালয়েশিয়াগামী থেকে ৩০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এরা সকলকে টেকনাফ সাগর উপকূলীয় এলাকা বাহারছড়ার নোয়াখালী, জুম্মাপাড়া, কচ্চপিয়া, বাঘঘোনা বাজার, টেকনাফ সদরের রাজারছড়া, লম্বরী, তুুলাতুলি, হাবিরছড়া, মিঠাপানিরছড়াসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট হতে ছোট ছোট ফিশিং ট্রলারে করে গভীর সাগরে অপেক্ষমান বড় ট্রলারে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য উঠানো হয়। রাতে (গতকাল) এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৭২ জনকে জীবিত এবং ১৫ জন রোহিঙ্গা নারী-শিশুর মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিহত ও নিখোঁজের সংখ্যা বাড়তে পারে। সেন্টমার্টিনদ্বীপের জনপ্রতিনিধি, নৌবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, বোট মালিক সমিতি উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ নুর আহমদ বলেন, ‘প্রায় দেড়’শ মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গা নিয়ে ভোররাতে সেন্টমার্টিনদ্বীপের পশ্চিমে ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। যাত্রীদের বেশির ভাগই নারী। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিহত ও নিখোঁজের সংখ্যা বাড়তে পারে’।
টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচাররোধে এত তৎপরতার মধ্যেও সাগরপথে অবৈধভাবে বিদেশ পাড়ি দেওয়া থামানো যাচ্ছে না। গতকাল (মঙ্গলবার) ভোরে বাহারছড়া উপকূল হয়ে ছেড়ে আসা ২টি ট্রলার অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার কারণে সেন্টমার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের অদূরে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে ডুবে যায়। সংবাদ পেয়ে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের সেন্টমার্টিনদ্বীপ স্টেশনের সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে যান। ডুবে যাওয়া ১টি ট্রলার এবং সাগর হতে ভাসমান ১১ জন নারী, ৪ জন শিশুর মৃত দেহ এবং ৭২ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে সেন্টমার্টিন জেটিতে আনা হয়।
উদ্ধারকৃতরা জানান, তাদের সাথে ১৫০ জন যাত্রী ছিল। উদ্ধারকৃত এসব রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষেরা উখিয়া-টেকনাফের কুতুপালং, বালুখালী, শামলাপুর, জাদিমোরা, নয়াপাড়া ও লেদাসহ বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। তারা দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে সাগর দিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিল।

বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পূর্বজোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার শুভাশীষ দাশ জানান, এ পর্যন্ত ১৫টি মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করে সেন্টমার্টিনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী চট্টগ্রাম পূর্ব জোনের সেন্টমার্টিনদ্বীপের স্টেশন কমান্ডার শফিকুল ইসলাম জানান, সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় একটি ট্রলার ডুবির ঘটনায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ৭২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ট্রলারে শতাধিক যাত্রী ছিল। এখনও সাগরে উদ্ধার কাজ অব্যাহত রয়েছে। নিহতদের লাশ এবং উদ্ধারকৃতদের সন্ধ্যায় সেন্টমার্টিনদ্বীপ থেকে টেকনাফে আনা হয়েছে।

টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ট্রলারে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছিলেন ইছমত আরা। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার মা-বাবা নেই।

মালয়েশিয়াতে পরিচিত অনেকে আছে। ওখানে গিয়ে তাদের কাউকে বিয়ে করে ফেলবো। কাজ নয়, বিয়ে করতেই মালয়েশিয়া যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেন্টমার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপের কাছে পৌঁছালে আমাদের ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে ১৫ জনের প্রাণহানি হলেও সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই’।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মালয়েশীয়াগামী খালেদা বেগম (৩৫) বলেন, আমার স্বামী মালয়েশিয়া রয়েছেন। সেখানে যেতে ছেলে মো. শাহাদ ও মেয়ে নাছিমাকে নিয়ে রাতে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে সাগর পথে রওয়ানা দিই। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে ট্রলার ডুবে গেলে সে ডুবন্ত ট্রলারের কাঠ ধরে কোনমতে প্রাণে বাঁচলেও দুই সন্তানকে চিরতরে হারাই’।
এদিকে মানব পাচারের জন্য রোহিঙ্গা মজুদের সংবাদ পেয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশের কয়েকটি দল উপকূলীয় এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট