চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

শহরে একখ- ‘মরুভূমি’ পাহাড়তলী

আল-আমিন সিকদার

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামকে বলা হয় পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ এক নগরী। নগরীতে পাহাড় বেষ্টিত এমন বেশ কয়েকটি এলাকা রয়েছে। এমনই একটা এলাকা পাহাড়তলী। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়ের তলানিতে গড়ে উঠা এ জনপদটির নাম পাহাড়তলী। এটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড।

৫ বর্গ মাইল আয়তনের এই ওয়ার্ডটির বেশিরভাগ জায়গাই বাংলাদেশ রেলওয়ের। তাইতো এই এলাকা ঘিরে রয়েছে রেলের বিভিন্ন স্থাপনা। শুধু কি তাই, এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক ও স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা। যার মধ্যে রয়েছে, বীর কন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মৃতি যাদুঘর, রেলওয়ে যাদুঘর এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রসহ আরো অনেক নান্দনিক স্থাপনা। এতো কিছু থাকার পরও এই ওয়ার্ডটি যেন একখন্ড মরুভূমি। কারণ, মরুভূমিতে যেমন মানুষ পানির জন্য হাহাকার করে তেমনি বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য যুগের পর যুগ ধরে হাহাকার করছে এই ওয়ার্ডে বসবাসরত প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য বিশুদ্ধ পানি অপরিহার্য হলেও এখানে পানির অভাব এখন নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে এক শ্রেণির মানুষ, চালিয়ে যাচ্ছে চড়া দামে পানি বিক্রির রমরমা ব্যবসা। এই ওয়ার্ডের আরো একটি পরিচিতি রয়েছে। সেটি হচ্ছে চাঁদাবাজ ও মাদক কারবারের আখড়া হিসেবে। তথ্য রয়েছে, সন্ধ্যার পর

এখানে বিভিন্ন স্থানে জমে মাদকের আড্ডা। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন কায়দায় অবৈধ বিষয়কে বৈধ করতে অভিনব কায়দায় চলে চাঁদাবাজি। রেলের জায়গা দখল নেওয়ার ভূমি বাণিজ্যতো রয়েছেই। এই ওয়ার্ডের বসিন্দা মো. আলমগীর। প্রায় ১৯ বছর ধরে এখানে বসবাস করার সুবাদে বিভিন্ন সময় মুখোমুখি হয়েছেন বিভিন্ন সমস্যার। বর্তমানে যে সমস্যাগুলো চরম অসহনীয় সেগুলোর কথা জানিয়েছেন পূর্বকোণকে। তিনি বলেছেন ওয়ার্ডের ভাঙ্গা রাস্তা, অপরিচ্ছন্ন নালা-নর্দমার কারণে অতিষ্ঠ হওয়ার কথা। পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন মাদকের সমস্যার কথাও। মাদক ব্যবসায়ীরা গোপনে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছে এমন অভিযোগ তার। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যত কাউন্সিলরের কাছে এসব সমস্যার সমাধান চান তিনি।

একই ওয়ার্ডের বসিন্দা জয়নাল আবেদীন সিদ্দিকি। পেশায় আইনজীবী। জন্মসূত্রে পাহাড়তলী ওয়ার্ডে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করছেন তিনি। পূর্বকোণকে জানিয়েছেন নিজ এলাকার দৃশ্যমান সমস্যাগুলো। যার মধ্যে রয়েছে মাদকের প্রভাব। তার মতে এলাকায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এই সমস্যার প্রধান কারণ। অভিযোগ করে বলেন, এই এলাকার রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হলেও ড্রেনেজ ব্যবস্থা এখনও অনুন্নত। এছাড়াও এখানে ভাসমান ও ছিন্নমূল জনগণের জন্যে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এই সমস্যাগুলোসহ বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি পূরণে ভবিষ্যত কাউন্সিলরের হস্তক্ষেপ চান তিনিও।
এদিকে, প্রত্যেক নির্বাচনের আগে কাউন্সিলর প্রার্থীরা এই সমস্যাগুলো সমাধানের স্বপ্ন দেখালেও তা আর কখনোই বাস্তবায়ন হয় না। এবারের নির্বাচনেও হচ্ছেনা তার ব্যতিক্রম। ভোটারদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দিচ্ছেন নানা ধরনের আশা, দেখাচ্ছেন দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধানের পুরোনো স্বপ্ন।
তবে কেন টানা কয়েকবার ক্ষমতায় থাকার পরও যুগ যুগ ধরে চলে আসা এসব সমস্যার সমাধান হয়নি এ প্রশ্ন রেখেছিলাম বর্তমান কাউন্সিলর মো. হোসেন হিরনের কাছে। তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমাদের এই ওয়ার্ডে সুপেয় খাবার পানির সংকট যুগ যুগ ধরে। ওয়ার্ডটি ভৌগলিক অবস্থার দিক থেকে অন্যান্য ওয়ার্ডের তুলনায় তুলনামূলক উঁচু হওয়ায় পানির এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ওয়াসার সাথে বেশ কয়েকবার আমরা এই বিষয়ে কথা বললেও তাদের পানির স্বল্পতার কারণে তারা আমাদের ওয়ার্ডে সংযোগ দিতে পারছে না। তবে ওয়াসা এই বছরের মধ্যেই সংযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আশাকরছি খুব শীঘ্রই এই বিষয়ে সমাধান করা সম্ভব হবে।’

চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকায় কোনো চাঁদাবাজি নেই। তবে একটি লাইনে চাঁদাবাজি হয়, তা আমি জানি। সেটা হলো জালালাবাদ এলাকায় চলাচলকারী গ্রামীণ সিএনজি স্ট্যান্ড। গ্রামীণ সিএনজি শহর এলাকায় চলাচল করার নিয়ম নেই তাই তারা পুলিশকে এবং এলাকার কিছু রাজনীতিবিদকে আমার জানা মতে প্রতিদিন ১০ টাকা চাঁদা দিয়ে এই সিএনজিগুলো চালায়। তবে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে আমি বেশ কয়েকবার ট্রাফিক ডিসি ও সিএমপিকে চিঠি দিয়েছি।’
মাদকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী নেই তবে কিছু মাদকসেবী আছে যারা টিনএজার। আমরা আমাদের মত করে গোপন কিছু কৌশলের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর মাদক বিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে এলাকা থেকে মাদক প্রায় নির্মূল করতে পেরেছি।’
গত পাঁচ বছরে এই ওয়ার্ডের জন্য কি কাজ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে এই ওয়ার্ডের উন্নয়নে ১৪০ কোটি টাকার বরাদ্দ পেয়েছি। যার মধ্যে ৫৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের মধ্যে সমাপ্ত হয়েছে ৯২ কোটি ২৩ লাখ ৮ হাজার টাকার কাজ। চলমান রয়েছে ৪৮ কোটি টাকার কাজ। আমার সমাপ্ত হওয়া কাজের মধ্যে রয়েছে ৩টি স্কুল ও ১টি কলেজ, ৪টি মসজিদ ও ৩টি মন্দিরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। পাশাপাশি শেখ রাসেল শিশু পার্ক, স্মৃতি সৌধ ও উম্মুক্ত মঞ্চ নির্মাণ, ওয়ার্লেসে অত্যাধুনিক ফুট ওভার ব্রিজ নির্মাণ, গয়নাখাল সংস্কার ও পাহাড়তলী কলেজ রোডসহ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সকল রাস্তার উন্নয়ন।’ আগামীতে জয়লাভ করলে এসব সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নকাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানান তিনি।
বর্তমান কাউন্সিলর মো. হোসেন হিরনের মত এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরী ও সাবেক ছাত্র নেতা ও ব্যবসায়ী মো. মাহমুদুর রহমান। অন্যদিকে, বিএনপির থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন নগর বিএনপির যুগ্ন-সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম দুলাল।
সম্ভাব্য প্রার্থীরা কে, কী বললেন

চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরী জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি এবার আওয়ামী লীগ থেকে কাউন্সিলর পদের প্রার্থী হতে চান। দল থেকে মনোনয়ন পেলে তিনি নির্বাচন করবেন। নির্বাচিত হলে নাগরিকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে ৮ দফা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবেন। এগুলো হল- মাদক ও চাঁদাবাজি নির্মূল করা, রাস্তা-ঘাটের সংস্কার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ভাসমান জনগণকে পুনর্বাসন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, আবর্জনা অপসারণ, পথশিশুদের জন্য স্কুল এবং মহিলাদের জন্যে কর্মমুখী প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ এবং ওয়ার্ডে একটি মাতৃসদন হাসপাতাল নির্মাণ।
সাবেক ছাত্র নেতা ও ব্যবসায়ী মো. মাহমুদুর রহমানও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন আওয়ামী লীগ থেকে। তবে দল অযোগ্য কাউকে মনোনয়ন দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আর মনোনয়ন যোগ্য কাউকে দিলে দলের সিদ্ধান্তকে মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে নির্বাচিত হলে এলাকার কিশোর গ্যাং নির্মূলসহ দুটি বিষয়ের উপর জোড় দিবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। যেগুলো হলো- এলাকার সুপেয় পানির অভাব পূরণ এবং রেলওয়ের জায়গা লিজ নিয়ে ভাসমান জনগণের পুর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তার মতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি অবশ্যই জয়লাভ করবেন।’

নগর বিএনপির যুগ্ন-সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম দুলাল। দল নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন তিনি। নির্বাচনে জয়লাভ করলে মাদক নির্মূল, ভাসমান জনগণের পুনর্বাসন ব্যবস্থা করা, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ও শিক্ষার মান উন্নয়নসহ নতুন তিনটি বিষয়ের উপর প্রাধান্য দিচ্ছেন তিনি। এগুলো হলো- খেলার মাঠের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, থিয়েটার নির্মাণ এবং মাতৃসদন হাসপাতাল নির্মাণ। তার ইচ্ছা জনগণকে সাথে নিয়ে এলাকার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট