চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভুয়া ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে নারী নির্যাতন মামলা !

বৈলতলী গ্রামীণ কল্যাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ষ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তদন্ত ষ চিকিৎসক না হয়েও ডা. পদবী ব্যবহার ষ লাইসেন্স ছাড়াই চলছে প্যাথলজি পরীক্ষা ষ চিকিৎসা সহকারীও ওষুধ লিখছেন

ইমাম হোসাইন রাজু

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:২৩ পূর্বাহ্ণ

চিকিৎসক নয়, তবুও নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহার করছেন তিনি। এখতিয়ার বর্হিভুত হলেও চিকিৎসা সহকারী নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে বিলি করছেন ব্যবস্থাপত্র। শুধু তাই নয়, সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও জালিয়াতি করে ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ বৈলতলী গ্রামীণ কল্যাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আর এই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি আদালতে মিথ্যা মামলার কাজে ব্যবহার করে আসছে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। শুধু তাই নয় সিভিল সার্জনের তদন্তে চন্দনাইশে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামের এই প্রতিষ্ঠানটি চালানোর জন্য সরকারি অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তবুও তারা দীর্ঘদিন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটিতে প্যাথলজির পরীক্ষা হলেও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর লাইসেন্স নেই তাদের। অভিযোগ রয়েছে, রোগী না দেখেই বৈলতলী গ্রামীণ কল্যাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। এমনকি ভুয়া মামলার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটি তাদের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও জালিয়াতি করে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত চিকিৎসা সহকারী মো. হাসিবুর রহমান। মূলত চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-১ এ দায়েরকৃত এক

মামলায় বিবাদী শরীফুল ইসলামের আবেদন তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নানা অনিয়মের চিত্র। সিভিল সার্জন কার্যালয় ও আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ অক্টোবর চন্দনাইশের বৈলতলীর ভ্ূঁইয়াবাড়ির বাসিন্দা স্ত্রী শারমিনকে তালাকের নোটিশ পাঠান সাতকানিয়ার খাগরিয়ার বাসিন্দা শরীফুল ইসলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ১৪ নভেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ চট্টগ্রামে একটি মামলা (নং ৬২১/২০১৯) করেন স্ত্রী শারমিন। তালাকের বিষয়টি গোপন রেখে যৌতুক দাবি ও মারধরের অভিযোগে শরীফুল ইসলাম ও তার বাবা-মা ও ভাইসহ মোট চারজনকে আসামি করা হয়। মামলাটি করার সময় বাড়ির পাশের চন্দনাইশের গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তারিখ জালিয়াতি করে নেয়া একটি মিথ্যা ব্যবস্থাপত্র যুক্ত করে দেন ওই নারী। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে গত বছরের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন বরাবর আবেদন করেন শরীফুল ইসলাম। এতে উল্লেখ করা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-১ এ মামলা (নং ৬২১/২০১৯) করার সময় উপস্থাপন করা উক্ত ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১ নভেম্বর রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন মো. হাসিবুর রহমান। অথচ সেদিন শুক্রবার (১ নভেম্বর) ছুটির দিন হওয়ায় গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধ ছিল। যার কারণে রোগী রেজিস্ট্রারে ১ নভেম্বর কারও নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। আরও উল্লেখ করা হয়, ডিএমএফ ডিগ্রিধারী চিকিৎসা সহকারী মো. হাসিবুর রহমান গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেন্টার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে আছেন। চিকিৎসা সহকারী হয়েও হাসিবুর রহমান নিজেকে ‘ডা. (ডাক্তার)’ উল্লেখ করে স্বাক্ষর-সিলসহ শরীফুলের স্ত্রীকে উক্ত ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। এমনকি কথিত রোগী শারমিনকে না দেখেই হাসিবুর ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী শরীফুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘কথিত রোগী শারমিনকে না দেখেই ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন কথিত ডাক্তার হাসিবুর রহমান। আমার সঙ্গে কথোপকথনে হাসিবুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জমির মালিকের অনুরোধে কথিত রোগী না দেখেই তিনি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। হাসিবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথনের এসব রেকর্ড আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।

উক্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য গত ১ জানুয়ারি লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ হানিফকে দায়িত্ব দেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন। সরেজমিন তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে গত ১৫ জানুয়ারি সিভিল সার্জন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ১ নভেম্বর উল্লেখ থাকা যে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেটি যাছাই করার জন্য গত ৯ জানুয়ারি সকালে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখি ১ নভেম্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী রেজিস্ট্রারে কারও নাম নেই। কারণ শুক্রবার হওয়ায় সেদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ ছিল। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, গত বছরের ১৩ নভেম্বর শারমিন সুলতানা উল্লেখ করে একজন চিকিৎসা নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ১ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখ উল্লেখ করে শারমিনের নামে আদালতে যে ২৯০৪৫১ নং ক্রমিকের ব্যবস্থাপত্রটি দেওয়া হয়েছে, সেটার অফিস কপিতে ১৩ নভেম্বর রোগী দেখার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে আরও বলা হয়, তদন্ত চলাকালে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্য কেন্দ্র সরকার অনুমোদিত কিনা এ ধরনের কোন প্রমাণপত্র তারা দেখাতে পারেননি। একই সাথে তিনি চিকিৎসক না হয়েও নামের আগে ডা. পরিচয় উল্লেখ করেন হাসিবুর রহমান। একই সাথে তিনি এখতিয়ারের বাইরে ওষুধ প্রেসক্রাইব করে আসছেন বলেও উল্লেখ করা হয় সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে।

এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর গত ২২ জানুয়ারি অভিযুক্ত হাসিবুরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গ্রামীণ কল্যাণের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক বরাবর চিঠি দেন চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তাতে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সিভিল সার্জনকে অবহিত করার জন্য বলা হয়। জানতে চাইলে গ্রামীণ কল্যাণ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক পূর্বকোণকে বলেন, ‘সিভিল সার্জনের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর হাসিবুর রহমানক সাময়িক বরখাস্থ করা হয়েছে’। বন্ধের দিন রোগী দেখেন এবং তা খোলার তারিখে রেজিষ্টারভুক্ত করা হয় এমন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি হয়তো ভুলবশত হয়েছে। আমরাতো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি’। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনুমোদন চেয়ে সিভিল সার্জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত তারা অনুমোদন দেয়নি’। অনুমোদন ছাড়া কিভাবে এতদিন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের অন্যসবগুলোর অনুমোদন রয়েছে, কিন্তু সিভিল সার্জন থেকে নেই। এটা সিভিল সার্জন নিজেই জানেন’। অভিযোগের বিষয়ে জানতে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেন্টার কো-অর্ডিনেটর মো. হাসিবুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পরিচয় জানার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পূণরায় যোগাযোগ করতে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। সর্বশেষ কল রিসিভ করার সাথে সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করার অনুরোধ করে অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে তিনি এসব অভিযোগ মিথ্য বলে উল্লেখ করেন। একই সাথে সিভিল সার্জন কর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদন সর্ম্পকে জানতে চাওয়া হলে হাসিবুর রহমান বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন সঠিক নয়। যা অভিযোগ করা হয়েছে, সম্পূর্ণ মিথ্যে। এরপর এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি’। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি এসব প্রসঙ্গে পূর্বকোণকে বলেন, ‘তদন্ত করে যা পাওয়া গেছে, তা তাদের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপককে (গ্রামীন কল্যাণ) পাঠানো হয়েছে। তারা এ বিষয়ে অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বলে একটি চিঠি পাঠিয়েছে’। অনুমোদনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিভিল সার্জন অফিস থেকে তাদের কোন অনুমতিই দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি দেখা হবে’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট