চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বার বার সময় নিয়েও উচ্ছেদ না করায় বন্দর চেয়ারম্যানকে তলব করেছে হাইকোর্ট

এক বছর পর ফের উচ্ছেদ প্রস্তুতি

ফের বেদখল হয়ে গেছে উচ্ছেদ করা সদরঘাট ও মাঝিরঘাট এলাকা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

এক বছর পর গতি পাচ্ছে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের। ইতোমধ্যেই বড় ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। অবৈধ স্থাপনাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে বন্দর। গতকাল মঙ্গলবার রাতে নৌপরিবহন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন শুধু দিকনির্দেশনার অপেক্ষা। গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ডাকঢোল পিটিয়ে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেছিল জেলা প্রশাসক। ৫ দিন অভিযান চালিয়ে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরপর কার্যক্রমে গতি হারিয়ে যায়।

সূত্র জানায়, বন্দর এবং জেলা প্রশাসনের ¯œায়ুদ্বন্ধের কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম থমকে যায়। আদালতের নির্দেশনার পর দায়সারাগোচের অভিযান চালানো হয়। ইতিমধ্যে আদালতের নির্দেশে দুইবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে বন্দর। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত বছর সদরঘাট ও মাঝিরঘাট এলাকা উচ্ছেদ অভিযানের পর কোতোয়ালী ও বাকলিয়া অংশে উচ্ছেদ করার জন্য সীমান্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বন্দরের অনুমতি নিয়ে চাক্তাই-রাজাখালী খালের মোহনায় গড়ে ওঠা মৎস্য অবতরণকেন্দ্র নিয়ে ¯œায়ুদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় বন্দরের সঙ্গে। বন্দরের অনুমতি বাইরে আশপাশের বিশাল এলাকায় দখল করে গড়ে ওঠে এই মৎস্য অবতরণকেন্দ্র, বরফকল ও হিমাগার। পরবর্তীতে বরফকল ও হিমাগার নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ এবং মালামাল সরিয়ে নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি উপেক্ষা করে নদীর তীর দখল করে নির্মাণ করা হয় হিমাগার ও বরফকল। বন্দরের ইজারা নিয়ে বিশাল এলাকা বেদখলের বিষয়ে দুই সংস্থার মধ্যে

টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। উচ্ছেদ প্রস্তুতির পর পিছু হটতে হয়েছে জেলা প্রশাসনকে। যারফলে উচ্ছেদ কার্যক্রমে খেই হারিয়ে ফেলে। তারপরও এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছিল। দুই সংস্থার টানাপোড়নের কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করল আদালত। গত বছরের ৯ এপ্রিল এক আদেশে কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৩০ দিনের মধ্যে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করে হাইকোর্টকে অবহিত করার নির্দেশ দেয় আদালত।

উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনার পর জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে অবৈধ দখলদারের তালিকা নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করায় একাধিকবার বন্দর চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শানো হয়। সর্বশেষ আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালন না করা হওয়ার ব্যাখ্যা জানাতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে তলব করেছে হাইকোর্ট। ২৬ জানুয়ারি তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু বন্দর চেয়ারম্যান সময় প্রার্থনা করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
রিট মামলার বাদী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ পূর্বকোণকে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আদালতের মাধ্যমে একাধিকবার সময় নিয়েছেন। গত বছরের ২৯ আগস্ট সর্বশেষ আদালত এক আদেশে তিন মাসের মধ্যে সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। ১৪ নভেম্বরের মধ্যে বাকি স্থাপনা উচ্ছেদের কথা ছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা প্রতিপালন না হওয়ার বন্দর চেয়ারম্যানকে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন আদালত। একই সঙ্গে ৩০ একর জায়গাজুড়ে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বলা হয়েছে।
এই নির্দেশনার পর গত ২০ জানুয়ারি বন্দর, সল্টগোলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ একর জায়গা উদ্ধার করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জনায়, গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টায় কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ বিষয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে বন্দরের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দ্রুত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে কর্মপন্থ নির্ধারণ করা হয়। দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়নি। সরকারের নির্দেশনা পেলে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বন্দর।

বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘দ্রুত বড় ধরনের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। মন্ত্রণালয় থেকেও এই বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে। সেই হিসাবে উচ্ছেদ প্রস্তুতি নিয়েছে বন্দর। এখন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’ উচ্ছেদ অভিযান ছাড়াও কর্ণফুলী নদীর মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
দেখা যায়, উচ্ছেদ চালানো সদরঘাট ও মাঝিরঘাট এলাকায় ফের বেদখলে চলে গেছে। অনেকটা জলে গেছে জেলা প্রশাসনের ২০ লাখ টাকা। একই সঙ্গে বন্দরের কয়েক লাখ টাকাও।

দেখা যায়, কর্ণফুলীর চাক্তাই-রাজাখালী খালের তীরে নির্মাণ করা হচ্ছে হিমাগার ও বরফকল। বন্দরের সংরক্ষিত দুই হাজার বর্গফুট জায়গায় অবৈধভাবে হিমাগার নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানায় বন্দর সূত্র। অথচ রাজাখালী খালের তীরে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে তা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখনো চালু করা হয়নি। একইভাবে পতেঙ্গায় বন্দরের ইজারা নিয়ে গড়ে ওঠেছে একটি বেসরকারি কন্টেনার ডিপো। বন্দর ইজারা দেওয়ায় তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েছেন জেলা প্রশাসন। এনিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে চলছে টানাপোড়েন।
একাধিক সূত্র জানায়, নদীর জায়গা দখল করে গড়ে ওঠেছে নানা স্থাপনা। বস্তিঘর থেকে শুরু করে বহুতল ভবন, গুদাম, ডিপো, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নদী দখলের তালিকায় রয়েছে হতদরিদ্র থেকে শুরু করে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর নাম। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করার জন্য নানা চেষ্টা চালিয়েছিল বাঘর-বোয়ালরা।
গত বছর একই সময়ে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতেও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছিল। বুড়িগঙ্গায় দেশের খ্যাতিমান অনেক শিল্প গ্রুপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে কর্ণফুলী নদীর উচ্ছেদ অভিযান। হাইকোর্ট ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও উচ্ছেদ অভিযান কেন বন্ধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চট্টগ্রামবাসী।

২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ৯০ দিনের মধ্যে দুই হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের রায় দেন আদালত। হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করেন।
হাইকোর্টে মামলাটি করেছিলেন মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ- পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিষয়ে গতকাল তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখার কোন সুযোগ নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ একাধিকবার সময় নিয়েছে। আদালতের নির্দেশ প্রতিপালন না করায় বন্দর চেয়ারম্যানকে আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনার পর গত সপ্তাহে ১০ একর জায়গা উচ্ছেদ করেছে বলে আদালতকে অবহিত করেছে বন্দর। অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য সময় নিয়েছে।’

গত বছরের ২ মার্চ চট্টগ্রামে পৃথক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেছিলেন, অর্থ সংকট কাটিয়ে কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ (সমঝোতা) করা হবে না। কৌশলগত কারণে বিরতি দিতে হয়। উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।’ ভূমিমন্ত্রী জাবেদ বলেছিলেন, ‘কর্ণফুলী উচ্ছেদের জন্য যত টাকাই লাগুক দেয়া হবে। টাকার জন্য উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ হবে না।’

দুই মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরও এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘কর্ণফুলী উচ্ছেদের দায়িত্ব এখন বন্দর কর্তৃপক্ষের। আমাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট