চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তিনশ পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে

ইমাম হোসাইন রাজু

২৬ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪২ পূর্বাহ্ণ

‘কষ্ট করে যা সঞ্চয় করেছি, চোখের সামনেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গত রাত না ঘুমিয়ে কোন রকম কাটালাম। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। সব নিয়ে গেল আগুনে। কিন্তু চিন্তা করছি, বাকি রাত কীভাবে কাটবে’। বললেন নগরীর পাঁচলাইশ এলাকার ডেকোরেটার্স কলোনিতে অগ্নিকা-ে সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হওয়া মো. হানিফ।

নগরীর মুরাদপুর, মির্জাপুল এলাকাসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকায় হেঁটে হেঁেটে চা বিক্রি করেই সংসার চালাতেন কুমিল্লার বাসিন্দা হানিফ। দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়েই বস্তিতে বসবাস ছিল তার। হানিফ ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা হলেও স্ত্রী কাজ করতে পাশের সুগন্ধা আবাসিকের বাসা-বাড়িতে। স্বামী-স্ত্রীর আয়েই চলতো তাদের সংসার। তবে আগুনেই যেন কাল হলো পরিবারের। শুধু হানিফের পরিবারেই নয়, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রায় তিনশ’ পরিবার এখন পুরোপুরিই গৃহহীন। যাদের মাথা গোঁজার ঠাই নেই বললেই চলে। ঠিকানা তাদের খোলা আকাশের নিচে। কথার প্রসঙ্গে চা বিক্রেতা হানিফ পূর্বকোণকে বলেন, ‘সব চলে গেছে, ঘুম কি করে আসবে। তবুও স্ত্রী আর সন্তানদের খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে দিয়ে, আমিই না ঘুমিয়ে ছিলাম। একেতো শীতের রাত, তারমধ্যে খোলা আকাশের নিচে থাকা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের ছিল বলেও উল্লেখ করেন হানিফ’। হানিফের পরিবারের মতো আগুনে পুড়ে যাওয়া বাকি পরিবারগুলোও চিত্র একই। গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়। অনেকেই আগুনে পুড়ে যাওয়া কক্ষে পূণরায় ঠাঁই নিতে পোড়া কয়লা সরাতে ব্যস্ত ছিলেন। আবার অনেকেই আশা নিয়ে পোড়া কয়লা সরিয়ে ব্যস্ত নিজের মূল্যবান জিনিসের খোঁজের। যদিও চারদিকেই ছিল পোড়া কয়লা। নিজের পরিশ্রমের সঞ্চয় যেন এখন অক্ষয় রয়েছে এমনেই আশা ছিল তাদের।

পোড়া কয়লা সরিয়ে খুঁজতে থাকা রিকশা চালক আহমেদুরের কাছে জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘রিকশা চালাতে গিয়ে কত মানুষের কতো কথা শুনতে হয়েছে, তবুও মাথায় ঘাম পায়ে নিয়ে যা আয় করেছি-তা দিয়ে কিছু স্বর্ণও কিনেছি। তা ছোট্ট ঘরের মধ্যেই ছিল। কিন্তু কপাল কেন এত খারাপ জানি না। তবুও মন মানছে না। তাই বারবার এসে একটু একটু সরিয়ে দেখছি। যদিও কিছু পাই’।
প্রয়োজন মাথা গোঁজার ঠাঁই : আগুনে পুড়ে গৃহহীন হওয়া পরিবারগুলো এখন প্রয়োজন মাথা গোঁজার ঠাঁই। যদিও জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব পরিবারগুলোর মাঝে খাবার বিতরণ ও কিছু বস্ত্র দেওয়া হয়েছে। তবে যা দেওয়া হচ্ছে তার চেয়ে ঠাঁই যেন তাদের গুরুত্ব। গতকাল শনিবার একাধিক পরিবারের সাথে কথা বলার প্রসঙ্গে এমনই জানালেন তারা।

ফারজানা আক্তার নামে এক বাসিন্দা পূর্বকোণকে বলেন, ‘যাই দেয়া হচ্ছে, কম বেশি পাচ্ছি। কিন্তু এই মুহুর্তে আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রয়োজন। পড়নের কাপড় ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের আর কিছুই নেই। হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার তাদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস বের করতে পারলেও সব কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুন লাগার পর থেকেই খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছি’।
সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর পাশেই খোলা মাঠের তাবু টাঙ্গিয়ে বসে আছেন গৃহহীন এসব পরিবারের সদস্যরা। মাথার নিচে হাত রেখেই অনেকেই ঘুমিয়ে আছে, আবার অনেকেই চোখের সামনে পুড়ে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন অপরকে। তবে রাতভর ঘুমহীন ছিল তা দেখেই বুঝা যায় তাদের। অন্যদিকে কিছু কিছু গলিতে ঘরের কর্তারা পুড়ে যাওয়া কয়লাগুলো সরাতে ছিল ব্যস্ত। বাকি রাতগুলো যেন সেখানে কাটাতে পারে তাই করছিলেন তারা।
কথার প্রসঙ্গে আবুল হাশেম নামে এক বাসিন্দা জানালেন, ‘আমরা গরিব, কেউ আমাদের দিকে তাকাবে না। অনেকেই আসবেন, দেখে দেখে চলে যাবেন। নিজের ঘর পুড়েছে, তার কষ্ট নিজেই বুঝি। কেউতো আর ঘর বানাই দিবে না। তাই নিজেই চেষ্টা করছি, যা পারি তা দিয়েই রাত কাটামু’।

ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ অনেকের : অগ্নিকা-ের ঘটনার পরপরই সরকারিভাবে জেলা প্রশাসন থেকে পরিবারগুলোতে ১২ কেজি চালসহ ১৬ কেজি করে ত্রাণ সামগ্রি দেওয়া হলেও তা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে অনেকের। এই ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। যদিও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি পরিবারকেই তারা ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। এদিকে জেলা প্রশাসনের ত্রাণের বাইরে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দেওয়া সাহায্যের বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজনীয় আসবাব পত্রের। কিন্তু একবেলা খাবার দিয়ে, দুইটা ছবি তুলে চলে যাচ্ছেন তারা। একটু পানি খাব, কিন্তু গ্লাস নেই। গোসল করবো, কিন্তু মগ নেই। ভাত খাব কিন্তু প্লেট নেই।’

মাফিয়া আক্তার নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘চাল ডাল দিয়েছে, কিন্তু তা কীভাবে রান্না করবো?। আমাদেরতো সবই পুড়ে গেছে, তাহলে এসব দিয়ে কি লাভ’।
খাবার দিল ডা. আফসারুল আমিন : ১০ নং সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য ডা. আফসারুল আমিন চৌধুরীর পক্ষ থেকে অগ্নিকা-ের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের এক হাজার সদস্যদের মাঝে শনিবার সকাল ও দুপুরে খাবার বিতরণ করেন তাঁর ছেলে ফয়সাল আমিন চৌধুরী। এসময় উপস্থিত ছিলেন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ন আহবায়ক কেবিএমন শাহাজাহান, নাসিরাবাদ ইউনিট আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক অহিদ চৌধুরী মুক্তি, এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান তারেক, ছাত্রলীগ নেতা দিদারুল রহমান তুষার প্রমুখ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট