চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র আশুরার ফজিলতপূর্ণ রোজা

হাশরের মাঠে সৌভাগ্যের অধিকারীরা

আরিফ খান সাদ

৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৪:৫৯ অপরাহ্ণ

হাশরের মাঠে সবার মধ্যে অন্যরকম অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করবে। সেই কঠিন পরিস্থিতির ভেতরেও কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ থাকবেন নিরাপদ ও শান্ত। পৃথিবীর জীবনে যারা পরকালীন জীবনের জন্য বিশেষ কিছু সঞ্চয় করেছেন, তারা হবেন সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিয়ে বিস্তারিত নিচে তুলে ধরা হলো:

বিচারের ভয়াবহতার বাইরে যারা

হাশরের মাঠে যাদের বিচার হবে, মনের দিক দিয়ে তাদের অবস্থা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। তবে কিছু মানুষ বিচারের ভয়াবহতার বাইরে থাকবেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন যে ব্যক্তির হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি জানতে চাইলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা কি বলেননি, যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব সহজ করে নেয়া হবে! রাসুল (সা.) বললেন, এটি হচ্ছে শুধু প্রদর্শনের ক্ষেত্রে। আর কেয়ামতের দিন যার হিসাব জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নেয়া হবে, তাকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে।’ (বুখারি: ৬৫৩৭; মুসলিম : ২৮৭৬)। এ থেকে বুঝে যাদের হিসাব জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নেয়া হবে না; তারা সৌভাগ্যবান ও নিরাপদ থাকবেন।

আরশের ছায়ায় আশ্রয় যাদের
হাশরের মাঠে সূর্য মানুষের মাথার কাছাকাছি নেমে এসে উত্তাপ ছড়াবে। তীব্র গরমে ঘামের দরিয়ায় হাবুডুবু খেতে থাকবে মানুষ। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগত সমস্ত মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ে সবাই অস্থির হয়ে পড়বে। সমগ্র জমিন সমতল থাকবে। কোনো গাছপালার ছায়া থাকবে না। একমাত্র আল্লাহর আরশের ছায়া থাকবে। সেই কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর কিছু সৌভাগ্যবান বান্দা সেই আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাত শ্রেণির মানুষকে সেদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কারস্বরূপ আরশের ছায়ায় স্থান দেওয়া হবে। যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। সাত শ্রেণি হলেন ১. নীতিপরায়ন শাসক ও কর্তা। ২. ওই যুবক; যে তার যৌবনকাল প্রভুর ইবাদতে অতিবাহিত করে। ৩. ওই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। ৪. ওই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এর ভিত্তিতেই তারা একত্র হয় ও পৃথক হয়। ৫. ওই ব্যক্তি যাকে অভিজাত বংশীয় সুন্দরী কোনো নারী আহ্বান করে আর জবাবে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৬. ওই ব্যক্তি যে গোপনে দান করে, এমনকি তার বাম হাতও জানে না তার ডান হাত কী দান করছে। ৭. ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে আর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।’ (বুখারি : ৬৬০; মুসলিম : ২৪২৭)

নূরের মুকুট লাভ করবে যারা
পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে গাইডবুক হচ্ছে পবিত্র কোরআন। যে ব্যক্তি এই মহাগ্রন্থের জ্ঞান অর্জন করবে ও সে অনুযায়ী চলবে হাশরের মাঠে তাকে বিশেষ সম্মানসূচক মুকুট ও পোশাক পরানো হবে। যার জ্যোতির্ময়তায় চারপাশ ঝলমল করতে থাকবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন কোরআন ধারণকারী ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে আগমন করবে। তখন কোরআন আল্লাহর নিকট আবেদন করবে, হে রব! এই ব্যক্তিকে সুসজ্জিত করুন। তখন তাকে মর্যাদামণ্ডিত মুকুট পরানো হবে। কোরআন বলবে, হে রব! আরও বৃদ্ধি করুন। তখন তাকে মর্যাদামণ্ডিত পোশাক পরিধান করানো হবে। কোরআন বলবে, হে রব! আপনি এর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। তখন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ২৯১৫)
এ সম্মান শুধু কোরআন ধারণকারী ব্যক্তির জন্যই নয়, তার মা-বাবাকেও হাশরের ময়দানে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হবে। হজরত বুরাইদা আসলামি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পড়ে, কোরআনের ইলম শিক্ষা করে ও সে অনুযায়ী আমল করে তাকে কেয়ামতের দিন নূরের মুকুট পরানো হবে। যার আলো সূর্যের আলোর মতো উদ্ভাসিত হবে। আর তার মা-বাবাকে এমন দুই জোড়া পোশাক পরানো হবে, পৃথিবীর সব আলো তাতে ম্লান হয়ে যাবে। তারা বলবে, আমাদেরকে এসব কেন পরানো হলো? বলা হবে, তোমাদের সন্তান কোরআনের ইলম ধারণ করার বিনিময়ে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ১/৫৬৮)। অন্য হাদিসে এসেছে, কোরআনের ইলম অর্জনকারী ব্যক্তির মা-বাবাকে নুরের মুকুট পরানো হবে। (আবু দাউদ : ১৪৫৩)

নূরের মিম্বরে থাকবে যারা
যারা আল্লাহর দ্বীনের জন্য নিজের দেশ ও সম্পদের মোহ ত্যাগ করেÑ আল্লাহর দরবারে তাদের মর্যাদা অসীম। হাশরের ময়দানে তারা নুরের আসন লাভ করবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বসা ছিলাম, তখন সকালের সূর্য উদিত হলো। রাসুল (সা.) বললেন, কেয়ামতের ময়দানে কিছু ব্যক্তির অবস্থা এমন থাকবে যে তাদের নুর এই সূর্যের আলোর মতো হবে। তখন আবু বকর (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা কি সেসব ব্যক্তি হব? রাসুল (সা.) বললেন, না, তোমাদের জন্য অন্য অনেক কল্যাণ থাকবে। তবে এসব হচ্ছে ওই ব্যক্তি যারা নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিজরত করে, সেসব দরিদ্র ও মুহাজির।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭০৭২; সহিহুত তারগিব : ৩১৮৮)। অন্য হাদিসে এসেছে, যারা পৃথিবীতে আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, বেশি পরিমাণে আল্লাহর জিকির করবে তারাও নুরের মিম্বরের বসে থাকবে। (তিরমিজি : ২৩৯০)

মিশকের টিলায় অবস্থান
হাশরের মাঠে কিছু ব্যক্তি মিশকের টিলায় আনন্দে থাকবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হাশরের মাঠে তিন শ্রেণির ব্যক্তি মিশকের উঁচু টিলায় ঘুরে বেড়াবে। পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগত সমস্ত বনি আদম তাদের প্রতি ঈর্ষা করতে থাকবে। তারা হচ্ছেÑ ১. ওই গোলাম ও কর্মচারী যে আল্লাহর হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করেছে এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের হকও পরিপূর্ণ আদায় করেছে। ২. ওই ইমাম, যার প্রতি মুসুল্লিরা পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট ছিল। ৩. ওই মুয়াজ্জিন যে দিনে-রাতে পাঁচবার আজান দিয়েছে।’ (তিরমিজি: ১৯৮৬, ২৫৬৬; মুসনাদে আহমাদ : ৪৭৯৯)

হাউজে কাউসারে তৃষ্ণা নিবারণ
সব মানুষ যখন তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকবে তখন আল্লাহ সব নবীকে শীতল পানির হাউজ দান করবেন। সবচেয়ে বড় হাউজ হবে আমাদের নবীজির। হজরত সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি বলেন, ‘নিশ্চয় প্রত্যেক নবীকে একটি করে হাউজ দেওয়া হবে। প্রত্যেক নবীই প্রতিযোগিতা করবেন কার উম্মত বেশি, কার কাছে বেশি মানুষ পানি পান করতে আসে। আমার খুব আশা যে, আমার হাউজে সবচেয়ে বেশি মানুষ পানি পান করতে আসবে।’ (তিরমিজি : ২৪৪৩)। হাউজে কাউসারের বিবরণ দিয়ে নবীজি বলেছেন, ‘আমার হাউজে কাউসারের পরিধি হবে ইয়েমেনের আদন বন্দর থেকে আম্মানের বালকা শহর পর্যন্ত। পনির রঙ হবে বরফের চেয়েও সাদা, স্বাদ হবে মধুর চেয়েও মিষ্টি। পানপাত্র হবে আকাশের নক্ষত্রের মতো অসংখ্য। যে ব্যক্তি একবার হাউজে কাউসারের পানি পান করবে সে কখনও আর তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (তিরমিজি : ২৪৪৪; ইবনে মাজা : ৪৩০৩)। পৃথিবীর জীবনে যারা নবীজির আদর্শ পুরোপুরি মেনে চলেছে এমন সবাই হাউজে কাউসারের অমিয় জল পান করে পরিতৃপ্ত হবে। সাহল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি হাউজে দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে থাকবে। যেই আসবে সেই সেখান থেকে পান করবে। আর যে একবার পান করবে সে কখনও তৃষ্ণার্ত হবে না। দলে দলে আমার উম্মতরা আসবে, আমি তাদের সবাইকে দেখে চিনতে পারব, তারাও আমাকে দেখে চিনতে পারবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
তবে যারা নবীজির আদর্শ মেনে চলেনি, নিজেদের মন মতো চলেছে, দ্বীনের ভেতর নতুন নতুন জিনিস সংযোজন করেছে, তারা মহানবী (সা.)-এর হাউজ থেকে পানি পান করতে পারবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি বলেন, ‘কেয়ামতের ময়দানে আমার উম্মতের এক দল লোক আমার হাউজের কাছে আসতে থাকবে, তবে তারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। আমি বলব, হে রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! তখন বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার পরবর্তীতে এরা কী বেদআত আবিষ্কার করেছিল!’ (বুখারি ও মুসলিম)

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট