চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও মাদকাসক্তি রোধ প্রসঙ্গে ইসলামের নির্দেশনা

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা ও মাদকাসক্তি রোধ প্রসঙ্গে ইসলামের নির্দেশনা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম শান্তির ধর্ম। এ শান্তি শারীরিক মানসিক আর্থিক আধ্যাত্মিক, সবদিক দিয়ে। পবিত্র ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে মানুষের দৈহিক কোন পরিবর্তন ঘটে না। আল্লাহর সৃষ্ট সব মানুষ বিচিত্র বর্ণে নানা ধর্মে বসবাস করে। ইসলাম পরিবর্তন ঘটায় মানসিক আধ্যাত্মিক ও নৈতিক। হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে যে মন-মানসিকতায় বেড়ে উঠেছিলেন সে চরিত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে বিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী বানিয়েছিলেন। আমাদের ইসলামী সমাজে মানুষের নৈতিক ও মানসিক চরিত্র সংশোধন করে ধুলোর মানুষকে ফেরেশতাদের গুণে গুণান্বিত করছেন আমাদের আলিম ও ইমাম সমাজ।

মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফের অসংখ্য জায়গায় নির্দেশ দিয়েছেন বিজ্ঞানভিত্তিক সুন্দর আলোচনা, ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে আল্লাহর সহজ পথে মানুষকে আহ্বান করতে। তিনি বলেছেন, তুমি তোমার প্রভুর পথে মানুষকে আহবান করো বিজ্ঞানময় ধারায় এবং সুন্দর সুন্দর ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে।’ তিনি আরও বলেছেন : ক্বাদ আফলাহা … সে ই সফলকাম হয়েছে যে কিনা নিজেকে পুত পবিত্র রাখতে জেনেছে।’

আত্মার পরিশুদ্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চাই প্রথমেই সুন্দর পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক চর্চা। পবিত্র ইসলাম ধর্ম এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। এজন্য একজন প্রসূতি কিংবা শিশু, কিশোর কিশোরী সকলের জন্য ইসলামের আলাদা মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ক বিধান রয়েছে। পরিণত বয়সের জন্যও পারিবারিক ও সামাজিক পরিম-লে নানা হুকুম আহকাম রয়েছে যা একজন মানুষকে মন ও মননে বলীয়ান করে রাখে।

পক্ষান্তরে, সমাজে কিছু কিছু বিষয় এমন রয়েছে, যা মানুষের সুপ্ত সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে চরম মানসিক অশান্তি নিয়ে আসে। যেমন পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, আর্থিক টানাপোড়েন, মাদকাশক্তি প্রভৃতি। এর মধ্যে মাদকাশক্তি একটি মারাত্মক জীবন বিপর্যয়ের নাম। পবিত্র ইসলাম ধর্ম এ সামাজিক অনাচার দূরীকরণে যুগান্তকারী অবদান রেখেছে।

বস্তুতঃ যে সকল বস্তু সেবনে মাদকতা সৃষ্টি হয় এবং যা বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে অথবা বোধশক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করে তাকে মাদকদ্রব্য বা খামর বলে। ইমাম রাযী (রা.) লিখেছেন, মদ ও মাদক সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের চারটি পর্যায়ে আয়াত নাযিল হয়েছে।

সর্বপ্রথম মক্কা-মুয়াজ্জামায় সূরা নাহলের ৬৭ নম্বর আয়াত নাযিল হয়: যার অর্থ- ‘এবং খর্জুর বৃক্ষের ফল ও আঙ্গুর হতে তোমরা মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক। এতে অবশ্যই বোধসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ এটি হচ্ছে মদ/মাদক সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের প্রথম বক্তব্য। ইসলামের প্রথম যুগে জাহিলিয়াত আমলের রীতি-নীতির মত মদ্যপানও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

(২) মদিনায় একবার হযরত ফারুকে আযম (রা.), হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রা.) এবং কিছুসংখ্যক আনসার সাহাবী রাসূলে করীম (সা.) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন: মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি বিবেচনাকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধন সম্পদও ধ্বংস করে দেয়। এ বিষয়ে আপনার নির্দেশ কি? এ প্রশ্নের উত্তরেই নিমোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়: ‘লোকেরা তোমার নিকট মাদক ও জুয়া সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বল, উক্ত দু’টি বস্তুতে মহাপাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য উপকারও রয়েছে। কিন্তু উহাদের অপকারিতা উহাদের উপকারিতা অপেক্ষা অধিকতর’ (২:২১৯)। কুরআনুল কারীমের এই আয়াতে মাদকের অনিষ্টকর ও অকল্যাণকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যা হোক উক্ত আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় মদকে হারাম করা হয়নি।

(৩) কুরআনুল কারীমের অপর একটি সূরায় বর্ণিত আছে যে, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের নিকটবর্তী হইও না যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার।’ সূরা নিসা:৪৩। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর অনেকে বুঝতে পারলেন যে, মদ্যপান খুবই গর্হিত কাজ। অতঃপর মাদকের অপকারিতা ও উহার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে উত্তমরূপে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল।

(৪) অতঃপর মদকে হারাম ঘোষণা করে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়: হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, শিরকি বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা সে সব বর্জন কর। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান চায় তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ সালাত হতে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা কি উহা হতে নিবৃত্ত হবে না’? সূরা মায়িদা: ৯০, ৯১। এ আয়াত নাযিল হওয়ার ব্যাপারে কিতাবে কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। একদিন সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) উন্নতমানের খাদ্য তৈরি করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কয়েকজন সাহাবাকে দাওয়াত করেন। তাঁদের একজন আনসারীও ছিলেন। সা’দ (রা.) তাঁদের জন্য একটি উটের মাথা রান্না করেন। এরপর তাঁদেরকে তা খাওয়ার জন্য আহ্বান জানালেন। তাঁরা তা ভক্ষণ করে মদ পান করে মাতাল হয়ে যান এবং বাজে কথা বলা আরম্ভ করে। সা’দ জবাবে কিছু বললে আনসারী রেগে যান এবং উটের হাড় দিয়ে আঘাত করে সা’দ (রা.) এর নাসিকা ভেঙ্গে দেন। এরপর আল্লাহতায়ালা মদকে অবৈধ ঘোষণা করেন। (তাফসীরে তাবারী শরীফ)।

মহানবী (সা.) বলেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ ব্যক্তির উপর মহানবী (সা.) লানত করেছেন। যে নির্যাস লাভ করে, প্রস্তুতকারী, পানকারী (ব্যবহারকারী), যে পান করায়, আমদানীকারক, যার জন্য আমদানী করা হয়, বিক্রেতা, ক্রেতা, সরবরাহকারী এবং লভ্যাংশ ভোগকারী। (তিরমিযী)। এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, যে বস্তু অধিক পরিমাণ জ্ঞান লোপকারী, তার কম পরিমাণও হারাম (আবু দাঊদ)। তিনি আরো বলেন: শরাব এবং ঈমান একত্রিত হতে পারেনা।’ ইসলামে যাবতীয় নেশার বস্তু হারাম।

সুতরাং শুধু মদ নয়, যে কোন মাদকদ্রব্যই হারাম। নেশা করার জন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজকাল নানারকম মাদকদ্রব্য ব্যবহার হয়। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দৈহিক, পারিবারিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা। মাদকদ্রব্য ব্যবহার প্রতিরোধে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

মাদকদ্রব্যের কুফলের মধ্যে প্রথমেই ধরা যায় শারীরিক ক্ষতি, যেমন এর দ্বারা সৃষ্টি হয়- খোসপাঁচড়া, মানসিক রোগ, স্মরণশক্তি রোধ, হার্টের অসুখ, কোষ্ঠকাঠিন্য, আলসার, জন্ডিস, প্রভৃতি। দ্বিতীয়তঃ এর দ্বারা নেমে আসে পারিবারিক অশান্তি, কমে যায় মানুষের আয় রোজগার। তৃতীয়তঃ সামাজিকভাবে বৃদ্ধি পায় নানা অপরাধমূলক আচরণ যেমনঃ চাকরি হারানো, সম্মান হারানো, স্কুল ঝরা, দুর্ঘটনায় নিপতিত হওয়া, উন্নয়নে বাধা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি।

আমাদের সমাজ মুসলিম প্রধান, রয়েছে মসজিদ মক্তবের আধিক্য। এখানে আজানের সুরে প্রভাত আসে আবার সন্ধ্যাও নামে আযানের সুরে। আমাদের মসজিদগুলোতে ইমাম সাহেবের কথা শুনার জন্য মানুষ নীরবে সময়দান করে। এক্ষেত্রে একজন ইমাম সঠিকভাবে ইসলামী শিক্ষায় সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারলে সমাজে মাদকাসক্তির মত অনেক অনাচার দূরীভূত হবে এবং হচ্ছেও। আলিম ইমামগণ পারেন মানুষের হতাশা দূর করতে, আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে মানসিক সুস্বাস্থ্য রক্ষায় সহযোগিতা করতে।

 

লেখক: অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

 

 

 

 

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট