চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

হাশরের মাঠে ‘আমলনামা’

আরিফ খান সাদ

৩১ জানুয়ারি, ২০২০ | ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

হাশরের মাঠে যার যার আমলনামা তার তার হাতে দেওয়া হবে। পৃথিবীতে করা প্রতিটি কর্মের হিসাব থাকবে সেই আমলনামায়। নেককার বান্দারা আমলনামা পাবেন ডান হাতে আর বদকাররা পাবে বাম হাতে। সেদিন ডানপন্থিরা যাবেন জান্নাতের দিকে, বামপন্থিরা যাবে জাহান্নামের দিকে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো।

আমলনামার জন্য উকণ্ঠা

হাশরের মাঠে আমলনামা পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো মানুষই স্থির হতে পারবে না। সবাই উৎকণ্ঠিত ও বিচলিত থাকবে কী যেন পরিস্থিতি হয়! হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, কেয়ামতের দিন কোনো প্রেমিক কি তার প্রেমাস্পদের কথা মনে করবে? তখন নবীজি বললেন, তিনটি মুহূর্তে কোনো মানুষ কারও কথা স্মরণ করবে না ১. মিজানের দাড়িপাল্লা স্থাপন করার পর আমলনামা ভারী হয় না হালকা হয় তা না জানা পর্যন্ত। ২. যখন আমলনামা আসতে থাকবে তা ডান দিকে (হাতে) আসে না বাম দিকে (হাতে) আসে তা না জানা পর্যন্ত। ৩. আর যখন জাহান্নাম গর্দান বের করবে। (মুসনাদে আহমাদ : ২৪৮৩৭; মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৭২২)

আমলনামা প্রদানের অবস্থা

হাশরের মাঠে মানুষের আমলনামা কয়েকভাবে দেওয়া হবে। যারা আল্লাহর দরবারে বিশেষ নৈকট্যশীল তাদেরকে আল্লাহর দরবারে ডেকে বিশেষভাবে আমলনামা প্রদান করা হবে। আর সাধারণ সবার আমলনামা ওপরের দিক থেকে ফেলা হবে। সেসব আমলনামা উড়তে উড়তে যার যার কাছে গিয়ে পড়বে। যারা নেককার তাদের আমলনামা ডান দিক দিয়ে পড়বে। আর যারা বদকার তাদের আমলনামা বাম দিক দিয়ে পড়বে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেকের আমলনামা তার ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য আমলনামা বের করব। সে তা উন্মুক্ত অবস্থায় পাবে। আমি তাকে বলব, পাঠ কর তোমার আমলনামা। তোমার হিসাব নেওয়ার জন্য তুমিই যথেষ্ট।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১৫-১৬)। কাফেরদের আমলনামা প্রদানের অবস্থা সম্পর্কে এসেছে, তা পিঠে পেছনের দিক থেকে দেওয়া হবে। (সুরা ইনশিকাক : ১০)

আমলনামা গ্রহণের অবস্থা

আমলনামা গ্রহণের সময় ভালো মানুষদের অবস্থা সব দিক থেকেই ভালো হবে। আর খারাপ মানুষদের অবস্থা সব দিক থেকেই খারাপ হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘হাশরের মাঠে এক ব্যক্তিকে ডাকা হবে। অতঃপর তার আমলনামা প্রদান করা হবে ডান দিক দিয়ে। তার শরীর হবে ষাট হাত দীর্ঘ, চেহারা হবে উজ্জ্বল, তার মাথায় থাকবে মণিমুক্তা খচিত মুকুট যা ঝলমল করতে থাকবে; এভাবে সে তার স্বজনদের কাছে ফিরে যাবে। সবাই তখন বলতে থাকবে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকেও এমন আমলনামা প্রদান করুন, এতে আমাদের জন্য বরকত দান করুন।

আর কাফের ও অবিশ^াসী ব্যক্তিদেরকেও এভাবে আমলনামা প্রদান করা হবে যে, তার শরীর ষাট হাত দীর্ঘ, চেহারা কালো হয়ে গেছে, মাথায় আগুনের টুপি পড়ানো; তার আত্মীয়-স্বজন এই অবস্থা দেখে বলবে, হে আল্লাহ! আমরা এ থেকে পানাহ চাই, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন পরিণাম দিয়েন না। হে আল্লাহ! একে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিন!’ (তিরমিজি : ৩১৩৬; ইবনে হিব্বান : ৭৩৪৯)

ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্তদের প্রফুল্লতা

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলকে (সা.) একবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! হাশরের মাঠে সহজ হিসাব কীভাবে হবে? তখন নবীজি বললেন, নেক বান্দাকে তার আমলনামা ডান দিক দিয়ে প্রদান করা হবে। সে তার মন্দ আমলনামা পড়তে থাকবে আর সাধারণ লোকজন তার নেক আমলনামা পড়তে থাকবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা তার মন্দ আমলকে নেক আমলে রূপান্তরিত করে দেবেন। লোকেরা বলাবলি করবে, এই বান্দার কি কোনো মন্দ আমল নেই? এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যার আমলনামা ডান দিকে দেওয়া হবে, তার হিসাব-নিকাশ তো সহজেই হয়ে যাবে আর সে তার স্বজনদের কাছে প্রফুল্লচিত্তে ফিরে যাবে।’ (সুরা ইনশিকাক : ৭-৯; আল-বুহুরুজ জাখিরাহ : ৬৫৫)

বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্তদের আকুতি

হাশরের মাঠে বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের চিত্র আল্লামা কুরতুবি (রহ.) এভাবে তুলে ধরেছেন ‘মন্দ আমলকারীদেরকে হাশরের মাঠে ডেকে যখন বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে তখন তার চেহারা কালো হয়ে যাবে আর চিন্তা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। সে তার অপরাধসমূহ পাঠ করে আরও বেশি চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়বে। যখন সে  শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন দেখতে পাবে ‘এসব তোমার বদ আমল। তোমার আজাব বহুগুণে বৃদ্ধি করা হবে।’ জাহান্নামের দিকে নজর করে তার চোখ  ঘোলাটে হয়ে যাবে এবং চেহারা হয়ে যাবে কালো। আর তাকে পরানো হবে গলিত আলকাতরার পোশাক। তাকে বলা হবে- যাও! তোমার বন্ধুদেরকে গিয়ে বল, যত পাপী ও অপরাধী আছে তাদের এ ধরনেরই শাস্তি হবে। সে যেতে যেতে বলবে  হায়! যদি আমাকে আমলনামা না দেওয়া হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। হায়! আমাকে যদি এ ধরনের আমলনামা না দেওয়া হতো। হায়! আমার মৃত্যুই যদি শেষ গন্তব্য হতো! আজ আমার ধন-সম্পদের ক্ষমতা ও বাহাদুরি সব ধ্বংস হয়ে গেল।’ তখন আল্লাহ বলবেন, ‘একে ধর, গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও।  অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর সত্তর গজ দীর্ঘ শিকল দিয়ে তাকে বাঁধো’। (সুরা আল-হাক্কাহ : ২৫-৩২)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, দুনিয়ার সত্তর গজ লম্বা শিকল  পরিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ওই শিকলের একটি কড়া যদি পৃথিবীর কোনো পাহাড়ে রাখা হতো, তাহলে সে পাহাড় গলে যেত। সে তার বন্ধুদেরকে ডেকে বলবে, আমাকে তোমরা চিন কি? তারা বলবে না, চিনি না। তবে তোমার অপমান প্রত্যক্ষ করছি। সে বলবে, আমি  অমুকের পুত্র অমুক।  তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই অনুরূপ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। (তাজকিরাহ ইমাম কুরতুবি : ২৭৯-২৮০)

বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী পৃথকীকরণ

আমলনামা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পর বিশ^াসী ও অবিশ^াসী দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআনে সুরা ওয়াকেয়ায় এই দল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এক দল হচ্ছে ‘আসহাবুল ইয়ামিন’ অর্থাৎ ডানপন্থি আর অন্য দল হচ্ছে ‘আসহাবুশ শিমাল’ অর্থাৎ বামপন্থি’। দুই দলকে দুই দিকে জমা করা হবে। এ মর্মে সেদিন ঘোষণা করা হবে ‘হে অপরাধীরা, আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও! হে আদমের সন্তানেরা! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দেইনি যে তোমরা শয়তানের উপাসনা কর না; নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন? আর আমারই ইবাদত কর; এটাই প্রতিষ্ঠিত পথ? শয়তান তো তোমাদের অনেক প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করেছে, তবুও কি তোমরা বুঝতে পারনি? এটাই সেই জাহান্নাম, যার সম্পর্কে তোমাদের ওয়াদা করা হয়েছিল। আজ তোমরা এতে প্রবেশ কর, কারণ তোমরা এটা অস্বীকার ও অবিশ^াস করতে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৫৯-৬৪)

জান্নাত ও জাহান্নামের কাছে উপস্থিতি

সমস্ত মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করার পর জাহান্নামিদের জাহান্নামের দিকে আর জান্নাতিদের জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। হাশরের মাঠের সে দৃশ্য কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘…কাফেরদের দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন জাহান্নামের কাছে এসে পৌঁছবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। জাহান্নামের রক্ষীরা তাদের বলবে, তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কি রাসুলগণ আসেনি, যারা তোমাদের কাছে তোমাদের রবের আয়াতগুলো তেলাওয়াত করতেন এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করতেন? তারা বলবে, অবশ্যই এসেছিলেন; কিন্তু কাফেরদের ওপর আজাবের বাণী সত্যে পরিণত হবে। আর যারা তাদের রবকে ভয় করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন সেখানে এসে পৌঁছবে এবং এর দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে তখন জান্নাতের রক্ষীরা তাদের বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা ভালো ছিলে। অতএব স্থায়ীভাবে থাকার জন্য এখানে প্রবেশ কর।’ (সুরা জুমার : ৬৯-৭২)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট