চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত শারীরিক সুস্থতা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

২৫ জানুয়ারি, ২০২০ | ৯:৩৯ অপরাহ্ণ

স্বাস্থ্যই সমস্ত সুখের মূল। শরীরকে সুস্থ এবং মনকে নির্মল রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চার বিকল্প নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে শৈশব থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সবারই শারীরিক সুস্থতার জন্য ব্যায়াম করা দরকার। পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হিসেবে ইসলামেও শরীরচর্চার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। প্রিয়নবী (সা.) নির্দোষ খেলাধুলা, ঘোড়দৌড়, কুস্তি ও তীর নিক্ষেপ চর্চার জন্য সবাইকে উপদেশ দিতেন।

সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা প্রতিটি মানুষের কাম্য। সুস্থতা-অসুস্থতায় ভিত্তি করে মানুষের জীবনযাত্রা ও কর্ম-পরিধি নির্ধারিত হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুর্বল মুমিনের তুলনায় সবল মুমিন অধিক কল্যাণকর ও আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে; যা তোমাকে উপকৃত করবে, সেটিই কামনা করো।’ (মুসলিম : ২৬৬৪)

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। সতর্কতা সত্ত্বেও কোনো রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হলে এর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রতি জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রোগ প্রতিরোধেও ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। এজন্য আমরা দেখতে পাই, যে বিষয়গুলোর কারণে মানুষের রোগ হয়, ইসলাম আগেই সেগুলোতে জড়াতে নিষেধ করেছে। ইসলামে হালাল-হারাম খাবারের বিবরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে তা সহজেই অনুমেয়।

ইবাদতের জন্য শারীরিক শক্তি

স্বাভাবিকতই ইবাদতের জন্য কায়িক ও শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োজন। শারীরিক শক্তি ও কায়িক সামর্থ্য আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। রাসুল (সা.) বলেছেন-‘যে ইমানদার ব্যক্তির শারীরিক শক্তি আছে, সে শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর কাছে প্রিয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৯৪৫)

কারণ ইবাদত করার জন্য শারীরিক শক্তি প্রয়োজন। আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার জন্যও শক্তি প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে মানবদেহ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বার্ধক্য আসার আগেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে পতিত হতে হয়। এজন্য শরীরের প্রতি যত্ন নেয়ার ব্যাপারে রাসুল (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এক সাহাবি সারা দিন রোজা রাখতেন আর রাতভর নামাজ পড়তেন। রাসুল (সা.) তাকে সতর্ক করেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার শরীরের হক রয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৭০৩; তিরমিজি, হাদিস : ২৩৫০)

এছাড়াও হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) পাঁচটি অমূল্য সম্পদ হারানোর পূর্বে সেগুলোর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। এর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য। তিনি বলেন, ‘পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিস আসার আগে গনিমতের অমূল্য সম্পদ হিসেবে মূল্যায়ন করো জীবনকে মৃত্যু আসার আগে, সুস্থতাকে অসুস্থ হওয়ার আগে, অবসর সময়কে ব্যস্ততা আসার আগে, যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে এবং সচ্ছলতাকে দারিদ্র্য আসার আগে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৮/১২৭; সহিহুল জামে, হাদিস : ১০৭৭)

যুগে যুগে শরীরচর্চা

প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের অনেক স্থানে কুস্তি খেলার একটা প্রচলন ছিল। এর মাধ্যমে পরস্পরের শক্তি পরীক্ষার একটা সুযোগ থাকে। শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার মানসিকতাও তৈরি হয়। ফলে এই খেলাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়। রাসুল (সা.)-এর যুগেও কুস্তি খেলার প্রচলন ছিল। বদরের যুদ্ধের আগে রাসুল (সা.) তার যোদ্ধা বাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুকদের শারীরিক সামর্থ্য যাচাই করেন। পাশাপাশি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মূলবাহিনী থেকে আলাদা করছিলেন।

এদের মধ্যে সাহাবি রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) ও সামুরা ইবনে মুররি (রা.) নামক দুই কিশোরও ছিলেন। তাদের যখন যোদ্ধা বাহিনী থেকে আলাদা করে দেয়া হচ্ছিল, তখন রাফে তার পায়ের অগ্রভাগের ওপর ভর করে দাঁড়ালেন। যাতে তাকে লম্বায় প্রাপ্তবয়স্কের মতো বড় দেখায়। সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণও হয়েছিলেন। তাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এই কৌশলের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পান।

কিন্তু সামুরা সেনাবাহিনীতে থাকার অনুমতি না পেয়ে রাসুল (সা.) এর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! রাফেকে যখন যোদ্ধা বাহিনীতে থাকার সুযোগ দিচ্ছেন, তখন আমাকেও থাকার অনুমতি দিন। কারণ আমি তাকে কুস্তি প্রতিযোগিতায় পরাজিত করতে পারি।’ এ কথা শুনে রাসুল (সা.) তাদের দুজনের মধ্যে কুস্তির আয়োজন করেন। তুমুল লড়াইয়ের পর সামুরা রাফেকে পরাজিত করেন। রাসুল (সা.) খুশি হয়ে তাকেও বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : বদর যুদ্ধের অধ্যায়)।

শরীরচর্চার উপকারিতা

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরচর্চা করলে মস্তিষ্ক থেকে নানারকম রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। এসব রাসায়নিক উপাদান চিত্ত প্রফুল্ল করে। শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি চেহারায় লাবণ্য ও ঔজ্জ্বল্য বাড়ায়। ফলে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ অনেক বেড়ে যায়। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর আধঘণ্টা হাঁটা, জগিং করা কিংবা হালকা ব্যায়াম অনেক কাজে দেয়।

ব্যায়াম ও শরীরচর্চার ফলে শরীরের প্রতিটি কোষে অতিরিক্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ হয়। এর ফলে আমাদের হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালী সচল থাকে। সমস্ত শরীরে প্রাণস্পন্দন ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। এটা কর্মস্পৃহা বাড়ায়, কাজে-কর্মে ও লেখাপড়ায় মনোসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী। ব্যায়াম অনিদ্রা দূর করে, অতি নিদ্রা হ্রাস করে। নিয়মিত যিনি শরীরচর্চা করেন, তার গভীর ঘুম হয়। শরীরচর্চার ফলে একজন বৃদ্ধকেও তরুণ লাগে। নিয়মিত শরীরচর্চা মনকে চাঙ্গা করে। ডায়াবেটিস রোগী রোজ ২ ঘণ্টার বেশি হাঁটলে ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যুর হার ৩৯% এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার ৩৪% কমে যায়।

প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের শারীরিক পরিশ্রম শরীরে ইনসুলিনের সহনশীলতা বাড়ায়। নিয়মিত শরীরচর্চায় ওজন কমে। দাম্পত্য জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। এ ছাড়াও শরীরচর্চার ফলে শরীর বেশ শক্তিশালী হয়, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমে। সংবহনের উন্নতি ঘটে, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায়। পেশি এবং হাড়গুলো শক্তিশালী হয়। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে কর্মশক্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে। স্মৃতিভ্রংশ ও অ্যালঝাইমার্স থেকে সুরক্ষা দেয়।

 

 

 

পূর্বকোণ/আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট