চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট

প্রযুক্তির স্পর্শে এগিয়ে যাচ্ছে নারী

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:২১ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান সরকার নারী শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন ও প্রসারকল্পে কাজ করে যাচ্ছে। এতে নারীর জীবনমান উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে তাদের পরিধি বাড়ছে। নীতি নির্ধারকদের অনুধাবন হচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশ ও দেশের উন্নয়নে নারীর অভিন্ন অবদান থাকা জরুরি। এছাড়াও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে নারীর কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি উদীয়মান প্রযুক্তিগত পেশায় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
টেকনোলজিতে দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সহজতর উপায়ে পাঠ দান করানো হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নে ইনস্টিটিউটে ল্যাব আধুনিকীকরণের ফলে শিক্ষার্থীরা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো দক্ষ জনশক্তি। দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমেই মূলধন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব। আমাদের মূলধন কম থাকতে পারে। আমাদের কিন্তু প্রচুর জনসংখ্যা রয়েছে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে এ জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।
নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে জাতীয় কর্মপন্থার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল স্বাস্থ্যসেবা, সকল পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা, পেশা ও বৃত্তিমূলক দিকনির্দেশনা, নিরাপত্তা, দাপ্তরিক সেবা ও সমান পারিশ্রমিক। অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে স্থাপিত হয়েছে চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অন্যতম। এখানে চারটি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হল-
১. আর্কিটেকচার এন্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন
২. কম্পিউটার
৩. ইলেকট্রনিক্স
৪. গার্মেন্টস ডিজাইন এন্ড প্যাটার্ন মেকিং
বিজ্ঞান ভিত্তিক ও প্রযুক্তিগত আবহ তৈরির প্রচেষ্টায় বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে মেধাবীদের জন্য উপবৃত্তি এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সুবিধাদি প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় শ্রমবাজারে একাত্ম হওয়ার সুযোগ ক্রমশ বাড়ছে। এক্ষেত্রে অত্র ইনস্টিটিউট হতে পাস করা ছাত্রীরা শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণে সক্ষমতা প্রদর্শন করছে।
আর্কিটেকচার এন্ড ইন্টেরিয়র ডিজাইন টেকনোলজি বিভাগের পাস করা শিক্ষার্থীরা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ইন্টেরিয়র ডিজাইন শাখায় ছাত্রীরা মেধার সাথে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। দেশি-বিদেশি আবাসন খাতে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্যণীয়। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এই বিভাগের ছাত্রীরা সৃজনশীল অভিরুচি প্রদর্শন করছে। কৌশলগত জ্ঞানের সাথে নির্মাণ কার্যের সামাঞ্জস্যতা প্রদর্শনের মাধ্যমে শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করে শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরেও কৃতিত্ব দেখিয়েছে।
কম্পিউটার টেকনোলজি বর্তমান আধুনিক শ্রমবাজারের চাহিদাকে মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক বাস্তব জ্ঞান প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রেরণামূলক সেমিনার সিম্পোজিয়াম এক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এর ফলশ্রুতিতে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর ছাত্রীবৃন্দ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে উল্লেখযোগ্য পদে আসীন। বর্তমানে আইসিটি মন্ত্রণালয় শিল্পকারখানা এবং পেশাগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাপেক্ষে ছাত্রীদের আধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান প্রদানে বদ্ধপরিকর। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত যে বিপ্লব তার সমন্বয় সাধন করে শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করে চলেছে কম্পিউটার টেকনোলজির ছাত্রীবৃন্দ। গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং প্রোগ্রামিং অ্যাপের উপর দক্ষতা অর্জন করে ছাত্রীরা বিভিন্ন বেসরকারি দপ্তর, হাসপাতাল, ব্যাংকগুলোতে এ্যাসিস্টেন্ট প্রোগ্রামার হিসেবে এবং ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে নিজেদের মেধার পরিচয় দিচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষায় নিজ দায়িত্বে এবং সরকারি বৃত্তির মাধ্যমে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত আছে। মোবাইল গেমিং অ্যাপ, ই-টিকেটিং এর মত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল জনপ্রিয় বিষয়ে তারা সম্পৃক্ত। এছাড়া তারা বিজনেস এ্যপ্লিকেশন প্রোগ্রামার ও নেটওয়ার্ক এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করছে।
ইলেক্ট্রনিক্স টেকনোলজি একটি জনপ্রিয় পড়ালেখার মাধ্যম। বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর বিশে^ ইলেক্ট্রনিক্স টেকনোলজি ছাত্রীদের দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছে। এ বিভাগের ছাত্রীরা ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শিল্পকারখানার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর যেমনÑ ওয়াসা, বিটিভি, সিটিভি এবং বিভিন্ন স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এছাড়াও ছাত্রীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেন এন্ড পি এল সি এবং মাইক্রোকন্ট্রোলার এন্ড এমবেডেড সিস্টেম এর উপর সম্যক ধারণা লাভের পর বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলছে।
গার্মেন্টস ডিজাইন এন্ড প্যাটার্ন মেকিং টেকনোলজি বর্তমানে পোশাকশিল্পের মানোন্নয়নে একটি বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। ফ্যাশন ডিজাইন, ক্যাড, প্যাটার্ন ডিজাইন আধুনিক পোশাক পরিচ্ছদ ধারণাকে আলাদা আঙ্গিকে রূপ দিয়ে যাচ্ছে। পোশাক এখন শুধু একটি আবরণ নয়, ব্যক্তিত্ব বিকাশের একটি মাধ্যম। মানুষের চিন্তা চেতনার জগতে আজ বিচরণ করছে আধুনিক পোশাক ধারণা। এর বিস্তৃতি পুরো বিশ^জুড়ে। এ বিভাগের ছাত্রীরা আধুনিক পোশাক বা ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে নিয়ে আসছে একটি নতুন মাত্রা। দেশের বিভিন্ন পোশাক শিল্প সমন্বিত ইন্ডাস্ট্রিতে তারা কম্পিউটার ক্যারেক্টার সফট্ওয়্যারের মাধ্যমে প্যাটার্ন ও মার্কার তৈরি করে থাকে। হাল ফ্যাশনের চাহিদাকে মাথায় রেখে যুগোপযোগী ব্যবহারিক লব্ধজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে একটি নতুন রূপ দিতে তারা বদ্ধ পরিকর। এছাড়াও বিভিন্ন স্বনামধন্য বায়িং হাউজে মার্চেন্ডাইজার হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছে চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিকের ছাত্রীবৃন্দ। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জোন হওয়ার কারণে ছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করছে।
রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ অর্জনে বর্তমান সরকার বিশাল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকার ২০২০ সালের মধ্যে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ভর্তির হার ২০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ দূরবর্তী ছাত্রীদের আবাসনের জন্য প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে দুটি হোস্টেলের সুব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া, মেধাবীদের জন্য এখানে উপবৃত্তির ব্যবস্থা আছে এবং দরিদ্র মেধাবীদের জন্য আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীদর নৈতিকতা ও মানবিকতা অনুশীলনের জন্য এখানে রয়েছে সততা স্টোর ও সততা ক্লাব। সততা স্টোরের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ নিজ দায়িত্বে (দোকানদার বিহীন) টাকা প্রদান পূর্বক ক্রয় করার সুযোগ পাচ্ছে।
সততা ক্লাব: কারো অপ্রয়োজনীয় জিনিস সততা ক্লাবে রেখে যাওয়া আর প্রয়োজনীয় জিনিস ক্লাব থেকে বিনামূল্যে নিয়ে যাবার সুযোগ পাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা যাতে বিপথে যেতে না পারে সেজন্য একজন বিভাগীয় প্রধানকে কাউন্সিলর নিয়োগ করা হয়েছে। তার দায়িত্ব হল শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদ ও মাদকের কুফল সম্পর্কে অবহিত করা। সেমিস্টার ভিত্তিক বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে গাইড শিক্ষক নিয়োগ করার মাধ্যমে একাডেমিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
ইন্ডাস্ট্রি-ইনস্টিটিউট লিংকেজ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি এর সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অত্যাধুনিক টেকনোলজি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ইন্ডাস্ট্রি এর বিভিন্ন বিষয়ের এক্সপার্ট এর মাধ্যমে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর সেমিনার ও ওয়ার্কশপ এর আয়োজন করা হয়। ইন্ডাস্ট্রি এর মালিকের মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা বিকাশের উদ্দেশ্যে এখানে সহ-পাঠক্রমের অংশ হিসেবে ক্রীড়া-অনুষ্ঠান, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যচর্চার ব্যবস্থা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মেধা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ২০১৪ সাল হতে প্রতিবছর স্কিল কম্পিটিশন এর আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করার গৌরব অর্জন করে। অত্র প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কিছু শিক্ষার্থী চীনে স্কলারশিপ এর মাধ্যমে বর্তমানে অধ্যয়ন করছে। প্রতিবছর বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী দক্ষ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার পাস করে। পাসকৃত ছাত্রীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। আমাদের কার্যক্রম নির্ভুল হওয়ার জন্য অভিযোগ/পরামর্শ বক্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত পরামর্শ অনুযায়ী কার্যক্রর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
লেখক-মহিলা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট