চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাদ্য-ভেজাল ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

সৈয়দা সারওয়ার জাহান

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

‘ভেজাল’ শব্দটি নিয়ে আমি ভাবতে শুরু করি আজ থেকে পনেরো বছর আগ থেকে। ভেজাল শুধু যে খাদ্যে আছে তা নয়, অনেক জায়গাতেই আছে। সরকারি চাকরি জীবনে সব ধরনের ভেজাল নিয়েই কাজ করেছি, সমস্যা দূর করার চেষ্টা করেছি, সফলও হয়েছি। তবে, যখনই আমি ওই জায়গা থেকে সরে গেছি তখনই আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতেও দেখেছি। যেখানে পুরোপুরিভাবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে ছিল সেখানে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক চেষ্টা করে তা প্রতিষ্ঠা করেছি। যেখানে নিয়ন্ত্রণ হাতে ছিল না সেখানে একটা ধাক্কা তো অন্তত দিয়েছি। যাতে সবার কাছে উপলব্ধি হয়েছে কি ছিল, কি হয়েছে বা কি হওয়া উচিত?
খাদ্যে ভেজাল তেমনই একটি ব্যাপার। এখানে নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশটাই ছিল একটা ঘটনার মাধ্যমে। সেটি ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করার পরে এক সিনিয়র জানতে চান কেন আমি সেখানে যোগদান করলাম। যেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটেরই কোন কাজ নেই, দু’জন ম্যজিস্ট্রেট কি কাজ করবে। কথাটা আমাকে খুব আহত করলো। আমি কেন আসলাম যদি কোন কাজই না থাকে। চিন্তা করলাম কি করা যায়, ম্যাজিস্ট্রেসির সাথে যে সমস্ত কাজ সম্পর্কিত সেগুলো জানবার চেষ্টা করলাম, সংশ্লিষ্ট আইন-কানুনগুলো পড়া শুরু করলাম। সিটি কর্পোরেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২-তে ৬৩টি অপরাধ ও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সেখান থেকে তিনটি ধারার অপরাধকে মানুষের জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক বিবেচনা করে কাজ করার চিন্তা করলাম। তখন সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট শাখায় ছিল মোট তিনজন কর্মচারী, একজন এমএলএসএস, একজন প্রসেস সার্ভার ও একজন পেশকার। খাদ্যে ভেজাল বা অস্বাস্থ্যকর, দূষিত হওয়া, পানি বা পরিবেশ দূষিত হওয়া নিয়ে কাজ করার জন্য কর্পোরেশনের হেলথ ইন্সপেক্টরকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিলাম। এরপর কাজ করা শুরু করলাম। অপর সহকর্মীকে বিষয়টা শেয়ার করলে তিনি বললেন এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করলে মানুষ রাস্তায় পিটাবে। তার কথায় আমি মোটেও পিছপা না হয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপর নির্ভর করে শুরু করলাম ভেজালবিরোধী অভিযান। প্রথমে সামান্য বাধা আসলো ভেজাল ও দূষণকারীদের নিকট থেকে। কিন্তু সেটি ছিল একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। ¯্রােতের মুখে খড়-কুটার মত উড়ে গেল। পরম শ্রদ্ধেয় প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর প্রতি আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছিলেন সে সময়। আমার এ কাজের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অনুরোধ, উপরোধ, তদবির তাকে টলাতে পারেনি, তদবিরকারী তাঁর যত কাছেরই হোক না কেন। তাঁর একটাই কথা ছিলÑসে ম্যাজিস্ট্রেট, সে অনেক আন্তরিক এবং সৎ। তার নিয়ম এবং আইনের গতিতেই কাজ করবে। তাতে তিনি বাধা তো দেবেনই না বরং সহযোগিতা করবেন। কোন ধরনের অন্যায় আবদার করার সুযোগ দেননি তিনি। যার ফলে, অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নির্বিঘেœ ভেজালবিরোধী অভিযান চালাতে পেরেছিলাম। সহকর্মীও উৎসাহের সাথে একই কাজ করার জন্য উদ্যোগী হলেন। অল্পসময়ের মধ্যেই অন্যন্যমাত্রায় নিয়ে গেল ভেজালবিরোধী আন্দোলন। অনমনীয় মনোভাব ও আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে স্বার্থান্বেষীমহল সাত মাসের মাথায় বদলি করালেন। একেবারে ডিভিশন ট্রান্সফারের আদেশ হলো। তা ঠেকিয়ে চট্টগ্রামেই থাকলাম। কারণ, পারিবারিক অবস্থার কারণে চট্টগ্রামে থাকা প্রয়োজন ছিল। অবশ্য কর্পোরেশনে ম্যাজিট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করার আগে কক্সবাজারে উপজেলা ম্যজিস্ট্রেট ও ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সেখানে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করেছিলাম। সেখান থেকে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করেছিলাম।

২০০৭ সালে দ্বিতীয়বার বদলি হয়ে কর্পোরেশনের সিআর ও ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করলাম ১০ মাস। আবারও ভেজালবিরোধী অভিযান, অবৈধ দখলদার উদ্ধার ও বকেয়া কর আদায়। আপোষ না করার কারণে আবারো বদলি করা হয় আমাকে। এবার চট্টগ্রাম ছাড়তে হলো। এক বছর ফেনীতে কাজ করে আবারো চট্টগ্রামে ফিরে আসি। ম্যাজিস্ট্রেসি না করলেও জমি উদ্ধার এবং উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করি জেলা পরিষদে।
দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা পেরিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ভেজালবিরোধী কাজ করার অদম্য উৎসাহ নিয়ে যোগদান করি। এখানে লোকবল খুবই কম। দ্বিতীয়ত কিছু টেকনিক্যাল বিষয় রয়েছে। যার কারণে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এককভাবে অনেক কাজ করতে পারে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক আগ্রহে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয় ১০ অক্টোবর ২০১৩ সনে। অতঃপর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সনে যাত্রা শুরু করে। শুধুমাত্র ডেপুটেশনে নিয়োজিত একজন চেয়ারম্যান, চারজন সদস্য, চার জন পরিচালক, একজন সচিব ও দুইজন উপসচিব নিয়ে কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ম্যজিস্ট্রেট ছিল সংযুক্তিতে ২ জন। নিজস্ব পুলিশ বা ইন্সপেক্টর নেই। সারাদেশে স্বাস্থ্য বিভাগের ৭২৮ স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাজ সম্পর্কে এবারে একটু খুলে বলি, নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর শুরুতেই বলা আছে ‘বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং তদ্লক্ষ্যে একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এতদসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন রহিতক্রমে উহা পুনঃপ্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন।’
আমাদের ট্রাডিশনাল ফুড চেইনে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলন বলতে গেলে প্রায় অনুপস্থিত। তার বদলে প্রচলিত সেকেলে পদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদন হতে শুরু করে ভোগ পর্যন্ত খাদ্য শৃঙ্খলের যেকোন পর্যায়ে খাদ্যমান নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের দায়িত্ব। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং খাদ্যে দূষণ ঘটানো-দু’ভাবে খাদ্য অনিরাপদ হতে পারে। দূষণের মধ্যে তিনটি ধরণ হতে পারে চযুংরপধষ, গরপৎড়নরধষ এবং ঈযবসরপধষ পড়হঃধসরহধঃরড়হ। চযুংরপধষ পড়হঃধসরহধঃরড়হ বলতে শক্ত বা ধাতব কোন কিছু যেমনÑবালি, পাথর, প্লাস্টিক ইত্যাদি যদি খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে পরবর্তীতে খাদ্য বিপত্তি বা রোগ সংক্রমণ বুঝায়।
দ্বিতীয়ত, অনুজৈবিক দূষণ খাদ্যের শৃঙ্খলের যেকোন পর্যায়ে ঘটতে পারে। কাঁচা বা রান্না করা খাদ্যে এটি হতে পারে। খাবার নির্ধারিত তাপমাত্রায় ফ্রিজে সংরক্ষণ না করলে যেমন দুধ ৫০ সেলসিয়াসের নিচে এবং মাছ, মাংস ও অন্যান্য একই জাতীয় খাবারÑ ১৮০ সেলসিয়াসের নিচে সংরক্ষণ করা না হলে খাদ্যে ব্যাকটেরিয়াল দূষণ ঘটতে পারে। দীর্ঘ সময় খাবার খোলা অবস্থায় ফেলে রাখলেও ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাংগাস দ্বারা অনুজৈবিক দূষণ ঘটে। তৃতীয়ত, খাদ্যে রাসায়নিক দূষণ ঘটে সার, কীটনাশক, বৃদ্ধি প্রবর্ধক হরমোন, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, সোডিয়াম বেনজয়েড, টেক্সটাইল ডাই, প্রিজারভেটিভ মিশ্রণের ফলে। সবজি, ফল, মাটি ও পানির মাধ্যমে এ দূষণ ফুডচেইনে প্রবেশ করতে পারে। খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সেক্টর। কৃষিজাত দ্রব্যে অতিরিক্ত পেস্টিসাইড ব্যবহার না করা এবং ইরড়ঢ়বংঃরপরফব বা ভার্মিপেস্ট ব্যবহার করা উচিত। রাসায়নিক সার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। পেস্টিসাইডের পরিবর্তে ফেরোমন ট্রাপ, হলুদ ট্রাপ ব্যবহার করতে হবে। পেস্টিসাইড যদি একান্তই ব্যবহার করতে হয় তার জন্য চঐও (চৎব ঐধৎাবংঃ ওহঃবৎাধষ) মেনে চলতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ঝঅঙ (সাব-এসিস্ট্যান্ট এগ্রিকালচার অফিসার) কৃষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন এবং বিষয়টি নিয়মিত মনিটর করতে হবে।
মাছের ক্ষেত্রে ফরমালিন, বৃদ্ধি প্রবর্ধক (এৎড়ঃিযচৎড়সড়ঃবৎ), মৎস্য ও প্রাণী খাদ্যের সাথে অন্যান্য দূষিত পদার্থ যেমন গইগ এর মিশ্রন ক্ষতিকর। গইগÑএ ক্ষতিকর পিরিয়ন প্রোটিন (যা ম্যাড কাউ রোগের কারণ), অন্যান্য রোগ-জীবাণু ও শুকরের উপজাত (চড়ৎপরহব) থাকতে পারে যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পোল্ট্রি খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হলে (যেমন: ট্যানারি বর্জ্য দ্বারা তৈরি খাবার) হেভি মেটাল (ক্রোমিয়াম, লেড ইত্যাদি) মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করে। বৃদ্ধি প্রবর্ধক, এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হলে শারীরিক বিপত্তি ও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে পারে। প্রাণিরোগ চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিকস্ ব্যবহৃত হলে উইথড্রয়াল পিরিয়ড মেনে চলতে হবে। তা না হলে এন্টিবায়োটিক দুধ বা মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে এবং এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি করবে।
সময়ের সাথে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই রোগের প্রাদুর্ভাব ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। খাদ্য ও দূষণের ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ। ফলে ঙহব ঐবধষঃয ধারণাটির ক্রমবিকাশ হচ্ছে। এতে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত দায়িত্ব গ্রহণ করা দরকার।
বিভিন্ন কারণে রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে চলে যায়। সেচের মাধ্যমে জমি হয়ে রাসায়নিক দ্রব্য এবং হেভি মেটাল ফুড চেইনে চলে আসে। গাজীপুরে সচেতনতামূলক কর্মশালা পরিচালনা করতে গিয়ে এ সত্য বিষয়টা উঠে এসেছে। হেভি মেটাল পশু ও মাছের মধ্যেও আসতে পারে, মাটি ও পানি থেকে। মাঠের ঘাস থেকে এবং ধানের শুকনা খড় থেকে গরু-ছাগলের মধ্যে এবং পানি ও মাটি থেকে মাছের মধ্যে হেভি মেটাল আসতে পারে।
কৃষকেরা শস্য, সবজি ও ফল উৎপাদনে যাতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপাদান ও জৈব সার ব্যবহার করেন সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরগুলোর মাধ্যমে এঅচ, এখচ, এঅয়চ, এঐচ, এগচ চালু করা যায় তাহলে উৎস হতে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যাবে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাথে সভা করে নিরাপদ খাদ্য বিশেষ করে নিরাপদ সবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস বিক্রয় করার জন্য আউটলেট খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ট্যানারি বর্জ্য যাতে পশু ও মৎস্য খাদ্যে মিশিয়ে বিক্রি করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।
হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছি। যেমন : খোলা খাবার না রাখা, পোড়া তেল ও রং ব্যবহার না করা, কাঁচা ও রান্না করা খাবার পৃথকভাবে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা, ফ্রিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে খাবার সংরক্ষণ করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, নিয়মমাফিক হাত ধোয়া, অসুস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে খাবার তৈরি না করাসহ আরো অন্যান্য বিষয়ে গাইড লাইন তৈরি করা হয়েছে।
আইসিডিডিআরবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণায় মানুষের রক্তে বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের রক্তে লেডের উপস্থিতি ধরা পড়ে। তাদের যৌথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বাংলাদেশের হলুদের গুঁড়োয় লেড ক্রোমেটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। লেড ক্রোমেট মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে শারীরিক, মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে, প্রাপ্ত বয়স্কদের স্মৃতিভ্রম, মাথাব্যথা, বিষণœতা, মনো-¯œায়ুবিক বৈকল্য সৃষ্টি করে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, রক্তশূন্যতা, উচ্চরক্তচাপ বৃদ্ধি করে, লিভার ও কিডনি ধ্বংস করে।
কিছুদিন আগে হলুদের গুঁড়ায় লেড ক্রোমেট পাওয়া যায়। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উৎপাদনস্থলে লেড ক্রোমেট মিশ্রিত করা না হয় পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। ল্যাব পরীক্ষায় জর্দা, খয়ের এগুলোতে লেড, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়াম পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া গুল, খয়ের ও জর্দা পরীক্ষা করে মারাত্মক কেমিক্যালের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। লেড, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মত ভারীধাতু গুল, খয়ের ও জর্দ্দায় পাওয়ার পর সতর্ক করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার, লিফলেট বিতরণ ও জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। লেড, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মত ভারীধাতুর কারণে শ্বাসনালীর গুরুতর সমস্যা, কিডনি ও লিভার ড্যামেজসহ ক্যান্সার ইত্যাদি হতে পারে।
এছাড়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গুঁড়াদুধ, শিশু খাদ্য বিভিন্ন প্রকার মসল্লা, চিনি, লবণ, পেস্টিসাইড, সার ইত্যাদি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেছে।
গত ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ইং তারিখে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (ঋঅঙ) এর মাধ্যমে সংগৃহীত একটি মোবাইল ল্যাবরেটরি ভ্যান বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে সরবরাহ করা হয়েছে। মূলত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার কাঁচা বাজারগুলোতে খাদ্য-পণ্য যেমন, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ, শাক-সবজি, বেকারি আইটেম, নানারকম প্রক্রিয়াজাত কৃষিজাত খাদ্য, পানি, মসলা ইত্যাদি খাদ্য-পণ্য ও উপকরণ দ্রুত পরীক্ষার (ঝপৎববহরহম ঞবংঃ) মাধ্যমে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও জীবাণুঘটিত দূষণ সনাক্ত করার সুবিধা এ ল্যাবে রয়েছে। অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন ও জেলাগুলোতে মোবাইল ল্যাব ভ্যান-এর কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
পাস্তুরিত তরল দুধের নিরাপদতা নিয়ে বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পাস্তুরিত দুধের অনুজীবীয় দূষণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় প্যাকেটের লেবেলিং-এ ৪০ সে. তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করুন” সতর্কবাণী মুদ্রণ নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে বর্তমানে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণে রয়েছে অসংক্রামক রোগের অন্যতম উৎস ট্রান্স ফ্যাটি এসিডযুক্ত খাদ্য তালিকা এবং খাদ্যের অনুষঙ্গ সমূহ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট বা ওহফঁংঃৎরধষষু-ঢ়ৎড়ফঁপবফ ঃৎধহং ভধঃঃু ধপরফং (রঞঋঅ) মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ হার্ট-অ্যাটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ডঐঙ এর হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ব প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
সাধারণত খরচ কমানোর জন্য হোটেল-রেঁস্তোরায় সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি, জিলাপি, চিকেন ফ্রাইসহ বিভিন্ন ধরনের ভাজা পোড়া খাবার তৈরির সময় একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয়। এ কারণে এসব খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যায়।
শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নির্মূল ক্রমেই বিশ্বজুড়ে একটি অগ্রাধিকার হয়ে উঠছে। ট্রান্স ফ্যাট নির্মূলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে, যেখানে কোনো খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ মোট ফ্যাট বা তেলের ২ শতাংশ (২ম/১০০ম) পর্যন্ত সীমিত রাখা অথবা খাদ্য উপকরণ হিসেবে আংশিক হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা চঐঙ এর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।
ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে একটি টেকসই নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে ঈবহঃৎব ড়ভ বীপবষষবহপব হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট