চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ফরমালিনমুক্ত বাজার আঁতুড়ঘরেই অপমৃত্যু

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

২০১২ সালের ৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার নগরীর তিনটি বাজারকে ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনটি বাজারে ফরমালিন শনাক্তকরণ মেশিনও বসানো হয়েছিল। বাজারভেদে পুলিশ সদস্যও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে নগরীর সবকটি বাজারে ফরমালিনমুক্ত করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিধিবাম, বছরখানেক যেতে না যেতেই ভেস্তে যায় সেই উদ্যোগ।
ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা জানায়, ওই সময়ে ফরমালিন নিয়ে চারদিকে ব্যাপক হৈচৈ হয়। মাছ-কাঁচা সবজি থেকে শুরু করে ফলমূলেও মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এজন্য চট্টগ্রামের বাজারগুলো ফরমালিনমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল পুলিশ প্রশাসন। শুরুতেই নগরীর কাজির দেউড়ি কাঁচা বাজার, ২নং গেট কর্ণফুলী কমপ্লেক্স কাঁচাবাজার ও বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারে মেশিন বসানো হয়। পরে ফইল্যাতলী ও মোহরার কাজিরহাট বাজারেও বসানো হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে নগরীর সবকটি বাজারে এই ফরমালিন পরীক্ষার মেশিন বসানো কথা ছিল।
নগরীতে ছোট-বড় মিলে অন্তত ২১টি বাজার রয়েছে। অধিকাংশ বাজার ঘুরে দেখা যায়, মাছে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকারক রঙ। চিংড়িতে জেলি মেশানো হচ্ছে। বিভিন্ন অভিযানেও ফরমালিন মেশানোর প্রমাণ মিলেছে।
মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন চৌধুরী জানান, নগরীর হাট-বাজারে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে মাছে ফরমালিন, ক্ষতিকারক রং ও চিংড়িতে জেলি মেশানোর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, ফিশারিঘাট মৎস্য আড়ত ও বাজারে কৌশলে এসব ফলমালিন ও রঙ মেশানো হয়। কোনো বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার মেশিন না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিনতে পারছেন না ক্রেতারা।
মাছ আমদানি-রপ্তানিতে মৎস্য পরিদর্শন মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে সনদ নিতে হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সনদ দেয় সরকারি সংস্থাটি। কিন্তু আমদানির পর দেশীয় বাজারে বিক্রির আগে ফরমালিন-রঙ মেশানো হয়। মূলত দেখতে সুন্দর ও তরতাজা করতে এসব মেশানো হয়।
জেলা ও উপজেলা মৎস্য বিভাগে ফলমালিন পরীক্ষার মেশিন রয়েছে। বর্তমানে এসব মেশিন অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। কীট সংকটের কারণে তা ব্যবহৃত হচ্ছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ভোক্তাদের অভিযোগ, রমজান মাসে ভেজালবিরোধী অভিযান কিছুটা সরব থাকে। এছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ে কালভদ্রে অভিযান চালানো হয়। এতে প্রতিনিয়ত ঠকছে ভোক্তারা।
দেখা যায়, নগরী ও উপজেলার হাট-বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। অরক্ষিত এসব বাজারে অবাধে ফরমালিনযুক্ত মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল বিক্রি হলেও দেখার কেউ নেই।
নগরীর ২১টি বাজারের মধ্যে তিনটি বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এ তিনটি বাজার হচ্ছে কাজির দেউড়ি কাঁচা বাজার, ষোলশহর কর্ণফুলী কমপ্লেক্স ও আগ্রাবাদ চৌমুহনী কর্ণফুলী মার্কেট। পরে বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার ও কাজিরহাট বাজারেও বসানো হয়েছিল। কিন্তু বছর না পেরুতেই ধীরে ধীরে এসব মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে। তা আর সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ষোলশহর ২ নম্বর গেট কর্ণফুলী কমপ্লেক্স বাজারেও ফরমালিন শনাক্তকরণ মেশিন বসানো হয়েছিল।
কর্ণফুলী কমপ্লেক্স কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ মো. এয়াকুব চৌধুরী বলেন, ‘ওই সময়ে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ী-শিল্প গ্রুপ ও বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহায়তায় এসব যন্ত্র বসানো হয়েছিল। প্রতিটি বাজারে ফরমালিন শনাক্তকরণ যন্ত্র বসানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বছরখানেক যেতে না যেতেই তা স্থিমিত হয়ে যায়। সেই মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে। সমন্বয়হীনতা ও দেখভালোর অভাবে ভালো উদ্যোগটি ভেস্তে গেছে।
নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বাজার রিয়াজ উদ্দিন বাজার, বহদ্দারহাট, চকবাজার, পাহাড়তলী বাজার, বকশিরহাটসহ
কাজীর দেউড়ি বাজারে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার মেশিন ছিল। এখন নেই। বিক্রেতাদের যেভাবে বিক্রি করেন, সেভাবে খাচ্ছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, যখন ফরমালিন পরিমাপক যন্ত্র ছিল তখন কিছু কেনার পর ফরমালিন বুথে এসে পরীক্ষা করিয়ে নিতাম। এজন্য বাজারে ফরমালিন অনেকটা কমে গিয়েছিল। বিশেষ করে রমজান মাস আসলে ফরমালিন বুথে ক্রেতাদের ভিড় থাকত। এখন তো কিছুই নেই।
নগরীর সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে রিয়াজউদ্দিন বাজার। অধিকাংশ ব্যবসায়ী এখন থেকে মালামাল নিয়ে নগরী ও জেলার বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। ১১০টি আড়ত ও ৪০০টি খুচরা দোকান রয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে ভেজালের আধিক্য দেখা যায়।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে কথা হয় শেখ আতিউর রহমানের সঙ্গে। ব্যাংক কর্মকর্তা আতিউর বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার জন্য বুথ বসানো হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তা অচল হয়ে গেছে। সরকারি এখন নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি বাজারে ফরমালিন পরীক্ষা যন্ত্র বসানো হলে সরকারের উদ্যোগ অনেকটা সফল হবে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণের লবণ ও মিঠা পানির মাছ বিক্রি হচ্ছে। নগরীর কয়েকটি বাজারে টাটকা ও ভালমানের মাছের জন্য সুনাম রয়েছে। প্রচুর সামুদ্রিক ও মিঠা পানির মাছ ব্যাপক পাওয়া যায়। দেখা যায়, প্রতিটি বাজারে রঙ মেশানো মাছ বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো বাজারে ফরমালিন পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত ক্রেতারা ঠকছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিরাপদ মাছ, মাংস ও তরিতরকারি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী কামরুন নাহার করেন, মাছে ফরমালিন আছে কিনা সন্দেহ নিয়ে খেতে হয়। অন্ধভাবে মাছ কিনতে হচ্ছে। এছাড়াও মৌসুমি ফলমূল ও কমলা, আপেল, মাল্টা নিয়ে রয়েছে বেশি সন্দেহ। একটি মাল্টা সংরক্ষণে রাখতে ১৫-২০ দিন থেকে মাস পেরিয়ে গেলেও পচন ধরে না। ফরমালিনযুক্ত থাকায় পচন ধরে না। মৌসুমি ফলমূলে প্রাকৃতিক কোন স্বাদ-গন্ধ পাওয়া যায় না।
ফরমালিনমুক্ত যন্ত্রে ব্যবহৃত কীটসহ সামান্য খরচ ছিল। বাজার সমিতির খরচের জোগান দিয়েছিল। ফরমালিনমুক্ত যন্ত্র কেনার জন্য বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট বাজার সমিতি আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল। তারপরও আঁতুরঘরে অপমৃত্যু ঘটেছে ফরমালিনমুক্ত বাজার।

লেখক ঁ নিজস্ব প্রতিবেদক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট