চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ

শ্যামল দত্ত

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে প্রধান একটি হলো খাদ্যের অধিকার। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা এর মধ্যেই পড়ে। কিন্তু দেশে দেশে এ অধিকার বিভিন্নভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। আমাদের দেশেও এ অধিকার পূর্ণমাত্রায় সুরক্ষিত নেই। খাদ্য অনিরাপদ হয় দূষণ ও ভেজালের কারণে। মূল খাদ্যদ্রব্য থেকে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু সরিয়ে নেয়া হয় কিংবা নতুন কিছু যোগ করা হয়, যা আমাদের মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা এর পুষ্টিমান কিংবা গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়, তাকে আমরা ভেজাল খাদ্য বলি। আর যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে খাদ্য দূষিত হয়ে যায়, তখন আমরা তাকে বলি দূষণ। সেটা হতে পারে অণুজৈবিক কিংবা রাসায়নিক দূষণ। খাদ্য স্বাভাবিক এবং ভেজাল ও অন্যান্য দূষণ থেকে নিরাপদ অবস্থায় ভোক্তার হাতে পৌঁছানো এখন একটি বৈশি^ক সমস্যা। পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো বেশি প্রকট। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে খাদ্যে ভেজাল ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করা, এর ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জানা এবং ভেজাল-দূষণ রোধে আমাদের করণীয় নির্ধারণ-এসবই মূলত এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়।
খাদ্যে দূষণ ও ভেজাল
নানা কারণে খাদ্য দূষিত হতে পারে। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, খাদ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ার যে কোনো পর্যায়ে শিল্পায়িত খাদ্য গ্রহণের অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে। খাদ্যদ্রব্যে উৎপাদন পর্যায়ে কীটনাশক বা বালাইনাশক, সংরক্ষণ পর্যায়ে পচনরোধক ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পর্যায়ে পুষ্টিবর্ধক ও স্থায়িত্ববর্ধক হিসেবে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশেও আমরা লক্ষ্য করছি, দিন দিন এসবের ব্যবহার বাড়ছে। যথাযথ পরিমাণে ব্যবহার করা হয় না বলে তা উৎপাদিত পণ্যকে দূষিত করে, যা গ্রহণ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
আর বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছি। চাল, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্য তেল, আলু, দুধ থেকে শুরু করে রুটি, কেক, মিষ্টি, বিস্কুট কিছুই ভেজাল থেকে বাদ যায় না। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। এই চালের সাথে মেশানো হয় কাঁকর। জানা গেছে, একশ্রেণির ব্যবসায়ী নি¤œমানের চালের সাথে ইউরিয়া সার মেশান। এতে খুব সহজেই নি¤œমানের চাল হয়ে যায় অত্যন্ত পরিষ্কার এবং দেখতে মনে হয় অনেক উন্নতমানের। তেলে মেশানো হয় কৃত্রিম রং ও ঝাঁজ, মসলায় ইটের গুঁড়ো, ঘিতে আলু। এ তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমনকি বাদ যাচ্ছে না শিশুখাদ্যও।
কয়েক সপ্তাহ আগেই আমরা জানতে পারলাম একটি ভয়াবহ তথ্য। জারের পানিতে রয়েছে প্রাণঘাতী জীবাণু। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একদল গবেষক জানিয়েছেন, রাজধানীর বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ করা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কলিফর্ম বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন, যেমন-ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রোটাজেয়ার সৃষ্টিতে উৎসাহ জোগায় বা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ফলস্বরূপ পরবর্তী সময়ে যেকোনো রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব দ্বারা এই দেহ খুব সহজেই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। নগরীর অফিস আদালত থেকে হোটেল-রেস্তোরাঁ সবখানেই জারের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ চাহিদা পূরণে গলি ঘুপচিতে গড়ে উঠেছে পানি জারে ভরে সরবরাহ করার কারখানা। তারা নিয়মানুগ পরিশোধনের তোয়াক্কা না করেই জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেবল জারের পানিতে প্রাণঘাতী জীবাণুর উপস্থিতিই নয়, বাজারে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত পানিতেও বিএসটিআই নির্ধারিত মান না পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এগুলো তো সরবরাহ করছে বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এই চিত্র যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণ
আধুনিক জীবনে শিল্পজাত খাদ্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর যথাযথ মান নিশ্চিত করা খাদ্যশিল্প সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানসমূহ এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আধুনিক মান নির্ধারণ ব্যবস্থাপনার করতে আইনগতভাবে বাধ্য। কিন্তু তারা সেটা করছে কিনা তা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? সরকারের নীতি, আইন-কানুন, তার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মতৎপরতা-এসবের মাধ্যমেই এটা নিশ্চিত হবে। খাদ্য উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ভোক্তার দ্বার পর্যন্ত খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত রাখা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরের দায়িত্ব।
নোঙ্রা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি ও বাজারজাতকরণও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক আলোচনায় আরেকটি বিষয় অনেক সময়ই দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়, তা হলো বাজারের পরিবেশ। আমাদের দেশে অধিকাংশ কাঁচাবাজার অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর। এই পরিবেশ খাদ্যপণ্যের মানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, অনেক সময় খাদ্যকে দূষিত করে। এভাবে খাদ্য দূষণের ঝুঁকি এড়াতে কাঁচাবাজারগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার দিকে সচেষ্ট হওয়া দরকার।
নীতি ও বিধিবিধান
বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নীতি ও বিধিবিধান কিন্তু কম নেই। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল নীতিতে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ নীতিগুলো হচ্ছে : বাংলাদেশ পরিবেশ নীতি-১৯৯৮; বাংলাদেশ খাদ্য ও পুষ্টি নীতি ১৯৯৭; এবং জাতীয় পুষ্টি নীতি-১৯৯৮: ব্যাপক খাদ্য নিরাপত্তা নীতি-২০০১ এবং নতুন জাতীয় খাদ্য নীতি-২০০৬: জাতীয় কৃষি নীতি-১০০১, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য নীতি-২০০১: এবং রপ্তানি নীতি ইত্যাদি।
নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত বিধিবিধানগুলোর মধ্যে উল্লেখ করা যায়Ñবাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ-১৯৫৯ এবং বিশুদ্ধ খাদ্য বিধিমালা-১৯৫৭; পশু জবাই (বিধিনিষেধ) এবং মাংস নিয়ন্ত্রণ (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-১৯৮৩; বিএসটিআই অধ্যাদেশ-১৯৮৫ (সংশোধনী আইন, ২০০৩); ধ্বংসকারী পোকামাকড় বিধি (প্ল্যান্ট কোয়ারেনটাইন)-১৯৬৬ (১৯৮৪ পর্যন্ত সংশোধিত); কৃষিপণ্য বাজার আইন-১৯৬৪ (সংশোধিত ১৯৮৫); মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ (সর্বশেষ সংশোধনী ১৯৮৫); সামুদ্রিক মৎস্য অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এবং বিধি-১৯৮৩; মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) বিধি-১৯৯৭; জরুরি পণ্য আইন-১৯৫৭, ১৯৫৮ ও ১৯৬৪; খাদ্য বা বিশেষ আদালত আইন-১৯৫৬; খাদ্যশস্য সরবরাহ (ক্ষতিকর কার্যাবলি নিরোধ) অধ্যাদেশ-১৯৫৬; পোকামাকড় ধ্বংসকারী ঔষধ অধ্যাদেশ-১৯৭১ এবং এ সংক্রান্ত বিধি-১৯৮৫ ইত্যাদি। ২০১৩ সালে পাসকৃত ‘নিরাপদ খাদ্য আইনটি বিস্তারিত কিছু বলার অবকাশ রয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য আইন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
২০১৩ সালে ১০ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য আইন অনুমোদন করে। এর আওতায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন ও পরিচালিত হওয়ার কথা। দীর্ঘসূত্রতা পেরিয়ে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। তবে যতদূর জানা যায়, এখন পর্যন্ত জনবল দেয়া হয়নি। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে ‘ধারদেনা’ করে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সাংগঠনিক কাঠামোই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়াই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন। জানা গেছে দেশের ৬৪টি জেলায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা জানি না এগুলো কবে কার্যকর হবে। নীতি ও আইন-কানুনের উপস্থিতিই যে যথেষ্ট নয়, তা এদেশের অন্য সকল ক্ষেত্রের মতো এ ক্ষেত্রেও প্রমাণিত। প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর রাখা। বলতেই হয়, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ দুই বছরেও কাক্সিক্ষতভাবে কার্যকর না হওয়া দুঃখজনক। আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল জোগান দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর করা হোক।
আমাদের করণীয়
উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত এই দীর্ঘ চেইনে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে আমরা দেখছি অন্তত তিনটি ধাপে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যারা মান নির্দিষ্ট করে দেবেন। যেমন সার, কীটনাশক, ফল পাকানোর রাসায়নিক ইত্যাদির মাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়া। এই মান সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করা, এ সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা এই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষগুলোর দায়িত্ব। কাজেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় রাখতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে উৎপাদক ও বাজারজাতের সঙ্গে জড়িতরা। তাদেরকে দূষণ-ভেজাল ও জনস্বাস্থ্যের প্রভাব সম্পর্কে জানাতে হবে, ওয়াকিবহাল করতে হবে এ সংক্রান্ত রক্ষণীয় মান এবং পালনীয় বিধিবিধানগুলো সম্পর্কে। এই জানানোর কাজটা করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। শেষধাপে রয়েছেন ভোক্তারা। তাদের সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এই সচেতনতা কার্যক্রম চলতে পারে।
খাদ্যে দূষণ-ভেজালের বিস্তৃতি, প্রকৃতি, পরিণাম এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের অনুসন্ধান অব্যাহত। এর অনেককিছুই আমরা সাধারণের অজানা। যেটুকু জানা যাচ্ছে তাতেই সবাই উদ্বিঘœ শুধু নয়, শঙ্কিতও। জানতেও পারছি না প্রাণ রক্ষার্থে আমরা যা কিছু গ্রহণ করছি তা প্রাণঘাতী কিনা। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা এখন বৈশি^ক সমস্যা। পৃৃথিবীর সব দেশেই নিরাপদ খাদ্যের ব্যাপারে সচেতন এবং মান সংরক্ষণে আধুনিক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করছে। আমাদেরও পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। এর জন্য দরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল করা। এ সংক্রান্ত কাজে প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটানো ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি। ভেজাল খাদ্যের ভয়াবহতা ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও জনসচেতনতা বাড়তে হবে। ভেজাল ও বিপজ্জনক খাদ্য বিক্রেতা ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো উচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকরের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

লেখক ঁ সম্পাদক, ভোরের কাগজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট