চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নিরাপদ পানি প্রাণের আকুতি

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৫৩ পূর্বাহ্ণ

জীবন ধারণের জন্য পানি অপরিহার্য। পানি ছাড়া জীবন অচল। পানি ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব। পৃথিবীর ৭১ শতাংশ জুড়ে পানি থাকলেও পানযোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র ৩ শতাংশ। তাও মাত্র ০.০১ শতাংশ পানি মানুষের ব্যবহার উপযোগী। নিরাপদ পানি, বিশুদ্ধ পানি বর্তমান পৃথিবীর সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি ও উদ্ভব পানি দিয়ে। মানুষের সৃষ্টিও একবিন্দু পানি দিয়ে। মানুষ, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদের দেহের ৬০%-৯৫% জুড়ে আছে পানি।
বিশ্বজুড়ে একটি কথা প্রচলিত, তা’ হল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে পানি নিয়ে। আমরা যে পানি পান করি, তা কতটুকু নিরাপদ তা প্রশ্নের দাবি রাখে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দূরে থাক বর্তমান প্রজন্মের জন্য কতটুকু পানি মজুদ আছে, তাও প্রশ্নের দাবি রাখে। পানিতে ঢুকে পড়ছে বিষ, বিষাক্ত পদার্থ, রাসায়নিক পদার্থ, যা জটিল রোগব্যাধির বিস্তার ঘটাচ্ছে। বিষাক্ত এ পানি আগুনে ফুটালেও দূষণমুক্ত হয় না। রাসায়নিকভাবে দূষিত পানি পানের কারণে ক্যান্সার, চর্মরোগসহ জটিল রোগব্যাধি ছড়িয়ে যাচ্ছে। শুধু দূষিত পানি থেকেই যে মানুষের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে তা নয়, বরং বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, ফসল ও ফলের ভিতর রাসায়নিক পদার্থ যুক্ত হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে যা’ লিভার, কিডনি ধ্বংসকারী জটিল রোগব্যাধির বিস্তার ঘটাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, পৃথিবীর অর্থনীতি পানির অভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে সংকুচিত হয়ে যাবে। পানি শুধু জীবন ধারণের জন্যই নয়, পানি অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কারণ, পানি মানেই নদ-নদী, সাগর, মহাসাগর আর নৌবাণিজ্য এবং মৎস্য আহরণ, নদী ভিত্তিক শিল্পায়ন এবং ব্যবসা বাণিজ্য। পানি প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রতিটি বিন্দু পানির উপর অধিকার রয়েছে মানুষ, প্রাণী ও জীবজগতের। পানি শুধু মানুষের ভোগের জন্যই নয়, পানি জীবন জীবিকা নির্বাহ করারও অপরিহার্য উপাদান।
সভ্যতা যেমন বেঁচে থাকে পানির উপর, সেই সভ্যতাই আবার ধ্বংস হয় পানির জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবী পড়েছে চরম পানি সংকটের ঝুঁকিতে। ভূগর্ভস্থ সঞ্চিত পানির পরিমাণ কমছে। কিন্তু বিপরীতে মানুষ বাড়ছে, পানির চাহিদাও বাড়ছে। পানি যতটুকু ব্যবহার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি পানি অপচয় হচ্ছে। বৃষ্টির পানি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পুনর্ভরণ হচ্ছে না। এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে মানুষকে। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ চরম পানি সংকটে নিপতিত হবে। পানির উৎস ধ্বংস করা, পানি দূষণ করা, পানির অপচয় করা মানবতাবিরোধী অপরাধ। কারণ, পানির উপর আছে মানুষের মৌলিক অধিকার। পানির উপর আছে জীববৈচিত্রের অধিকার। সুপেয় পানি ঐ পানি, যে পানিতে দ্রবীভূত লবণাক্ততার মাত্রা ৫০০ পিপিএম এর কম থাকে। পৃথিবীতে সুপেয় পানির পরিমাণ ২ থেকে ৫% – ২ থেকে ৭%। এর বাইরে বায়ুম-লে বায়বীয় আকারে থাকে ০.০৪% পানি। বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নই পানি সংকটের কারণ। এর ফলে নদী, নালা ও জলাশয়ের দুই পাড় ভরাট হয়ে পানির ভান্ডার হ্রাস পাচ্ছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি অতি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর কমে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা নদীর পানি অতিমাত্রায় দূষিত হওয়ার কারণে পানি পরিশোধনে আধুনিক প্রযুক্তিও অকার্যকর হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর ৭টি দেশ বর্তমানে চরম পানি সংকটের ঝুঁকি মোকাবিলা করছে। কারণ, এসব দেশ তাদের পানি ভা-ারের ৮০% প্রতি বছর ভোগ করছে। বর্তমানে কাতার, ইসরায়েল ও লেবানন পানি সংকটাপন্ন দেশে পরিণত হয়েছে। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই পানি সংকট তৈরি হচ্ছে না, পানি ব্যবহারের অব্যবস্থাপনা অর্থাৎ অপচয় ও দূষণ পানি সংকটের প্রধান কারণ। আমরা খুব অদক্ষতার সাথেই পানি ব্যবস্থাপনা করছি। বেসিন, কমোডের পানি এবং গোসলের পানিকে আমরা বাগানের কাজে, কৃষি কাজে, গাড়ি ধোয়ার কজে ব্যবহার করতে পারি। একটি বাসযোগ্য বাড়ির মূল্যবান সূচক নিরাপদ পানি। বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩’তে পানি সংরক্ষণের বিষয়ে দিকনির্দেশনা আছে, যার সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। পানি ব্যবস্থাপনার সাথে খাদ্য নিরাপত্তাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পানি ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা। এসডিজি গোল-৩০ এ পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পানির অভাবে অর্থাৎ পানি সংকটের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ১৪% এবং আফ্রিকার দেশগুলোয় জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৬% কমবে। ঢাকা, চট্টগ্রামে পানির সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ যে জায়গায় বাস করে, সেখানে বছরে প্রায় ১মাস পানি সংকটে নিপতিত হয়। ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর পানি চাহিদার ৭৮% পূরণ করছে ভূ-গর্ভস্থ পানি দিয়ে, এর পরিণাম ভয়াবহ। বর্জ্যরে ভারে ক্লেদাক্ত হয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, তুরাগের পানি। চট্টগ্রামেও বিষাক্ত পয়োবর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। পানি সংকট মোকাবিলায় ছাদে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বর্তমান সময়ের দাবি। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটি বাসায় রয়েছে বৃষ্টির পানি রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা।
বৃষ্টির পানি ছাদে ধরে রেখে তা পানির আধারে সঞ্চিত করে টয়লেট কিংবা বাগানের বা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করছে তারা। মেলবোর্নে মোট পানির ৫২% বৃষ্টির পানি থেকে ব্যবহার করা হয়। টোকিওতে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে তার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
পানি দূষণের আরেক প্রধান কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য। তাছাড়া রাসায়নিক কীটনাশক পানিতে মিশে খালবিল, নদী-নালা, কৃষি জমিতে যাচ্ছে, এতে পুরো খাদ্যচক্রও বিষাক্ত হচ্ছে। খ্যাতনামা ইংরেজি কবি স্যমুয়েল টেইলর সমুদ্রের চারপাশে অপানযোগ্য অথৈ পানির ভান্ডার দেখে বলেছিলেন, ‘ডধঃবৎ, ধিঃবৎ বাবৎুযিবৎব, হড়ঃ ধ ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ’। তেমনি নদ-নদী বেষ্টিত বাংলাদেশেও পানযোগ্য নিরাপদ পানি প্রাপ্তি এখন দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি আল্লাহর নিয়ামত। জীবনের উৎস এবং প্রাণের উৎস পানি। পানিই জীবজগতের আদি উৎস। নদ-নদী, জলাধার সবই আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। সুতরাং পানির প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিয়ে পানির নিরাপদ সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক ঁ মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর
ই-মেইল : সসঁহরৎপ@মসধরষ.পড়স

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট