চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশুদ্ধ বায়ু নিশ্চিতে জরুরি পদক্ষেপ

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১২:৪৭ পূর্বাহ্ণ

বাতাসের মান নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজ্যুয়ালের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ১৯ নভেম্বর থেকে এক নম্বরে রয়েছে ঢাকা। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তারপরেই রয়েছে চট্টগ্রামের স্থান। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গত রবিবার সকাল ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এরপর কয়েক ঘণ্টার জন্য মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর ও ভারতের কলকাতা শহর দূষণের দিক থেকে ঢাকাকে ছাড়িয়ে যায়। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর ঢাকা আবার শীর্ষে চলে আসে। গবেষকরা বলছেন, চলতি মাসে এ পর্যন্ত আট দিন ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এ খবর নিশ্চিত অনেক উদ্বেগের এবং আতঙ্কজনকও। কেননা বায়ু মানুষের জীবনধারণের সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজ। আট বছর ধরে এই তিন উৎস ক্রমেই বাড়ছে। অথচ আমরা একটু দৃঢ়পদক্ষেপ নিলেই এই উৎসগুলো বন্ধ করতে না পারলেও অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বায়ুদূষণের জন্য নানা ধরনের উন্নয়নকাজের চেয়ে বেশি দায়ী নগরীর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ইটভাটাগুলো। গবেষণার ফলাফলে জানা যায়Ñ শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য এসব ইটভাটা দায়ী ৫৮শতাংশ। আমরা মনে করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটু শক্ত হলেই এই দূষণের উৎসমুখগুলো অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে জনসচেতনতাও অবশ্য জরুরি।
আমরা জানি, বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করলে মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় না। তবে বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবে মানুষ দ্রুতই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। সামান্য কিছুটা সময় বাতাস গ্রহণ করতে না পারলে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ঠিক একইভাবে বায়ুর বিশুদ্ধতা না থাকলে তা-ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
দূষণ ঠেকাতে যেসব আইন আছে, সেগুলো না মানার কারণে ঢাকার দূষণ দৃশ্যমান হচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বাতাসে যেসব ক্ষতিকর ধূলিকণা ও রাসায়নিক পদার্থ মিশে থাকে তা খালি চোখে দেখা যায় না। কিন্তু এসব ধূলিকণা ও রাসায়নিক পদার্থের কারণে মানুষের ফুসফুস আক্রান্ত হয়। শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। আর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, রাজধানী ঢাকার বাতাস এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমরা আশা করবÑ ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের দূষণরোধে কার্যকরী ব্যবস্থাগ্রহণের পাশাপাশি জনগণও স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে।
বিশুদ্ধ বাতাসের প্রত্যাশায়
পানির অপর নাম জীবন কিন্তু পানির চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাতাস। কারণ আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন দুই থেকে চার লিটার পানি পান করতে হয়, অন্যদিকে আমাদের ফুসফুসের জন্য প্রয়োজন দুই হাজার লিটার নির্মল বাতাস। তাছাড়া পানি পানের বিরতি রয়েছে। অন্তত একঘণ্টা পানি পান না করলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু এক মিনিট নিঃশ্বাস বন্ধ করে বেঁচে থাকা দুরূহ। কিন্তু সেই বাতাস যদি দূষিত হয়, বিষাক্ত হয়, তাহলে নিঃশ্বাসের সঙ্গে সেটাও আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে। অর্থাৎ নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রতিদিন আমরা অনেক ক্ষতিকর পদার্থ শরীরের ভেতর গ্রহণ করছি।
গত বছর দেশের ১১টি স্থানের বাতাস পরীক্ষা করে জানা গেছে, বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন-মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কমপাউন্ড, পার্টিকুলেট ম্যাটার বা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব ক্ষতিকর উপাদানের ফলে ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (অ্যাজমা/হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট), হৃদরোগ ও স্ট্রোক, চর্মরোগ ও শ্বাসনালির অন্যান্য রোগব্যাধি বাড়ছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে যারা এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের মৃত্যু-ঝুঁকিও ক্রমশ বাড়ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে বায়ুদূষণের উৎসগুলো স্পষ্ট হয়েছে। ঢাকার বাতাস বিষিয়ে তোলা ধোঁয়া এবং ধুলোর ৫৮% আসে শহরের চারপাশে এবং ভেতরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ইটভাটা থেকে, ১৮% পথের ধুলো থেকে, ১০% যানবাহন থেকে, ৮% বিভিন্ন কারখানার জ্বালানি থেকে এবং ৬% অন্যান্য উৎস থেকে। যদিও এ তথ্য নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যানবাহনজনিত দূষণ আরো বেশি। তা ছাড়া এতে অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যার প্রধান কারণ ধূমপান ও রান্না। তবু বায়ু দূষণের প্রভাব বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন গত বছরের শীতে ঢাকায় ঠা-া কম অনুভূত হয়েছে। বর্ষাতেও বৃষ্টির অভাব লক্ষ্য করা গেছে। চট্টগ্রামের অবস্থাও এরচেয়ে ব্যতিক্রম নয়।
৪০০ বছরের ঐতিহ্যের ঢাকা শহর আজ বিশ্বের দশটি নিকৃষ্টতম শহরের মধ্যে অষ্টম স্থান করে আছে। ঢাকার বাতাস মারাত্মকভাবে দূষিত। এ তো গেল আমাদের দেশের কথা। বর্তমানে সারা বিশ্বে বায়ুম-লে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বিগত তিন মিলিয়ন বছরের মাঝে সর্বোচ্চ এবং এটা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনটা গত ৬৬ মিলিয়ন বছরে দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে এর প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। উচ্চ মাত্রার দূষণের ফলে রাজধানী বেইজিংসহ চীনের ২৩টি শহরে উচ্চ সতর্কতা (রেড অ্যালার্ট) জারি করা হয়েছিল। গত বছর বেইজিংয়ে তিন হাজার ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের শিল্পকারখানা বন্ধ করা হয়, যেগুলো বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ছিল। বন্ধ রাখা হয়েছে সড়কের সব ধরনের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ। ভারতের নয়াদিল্লিতে বায়ুদূষণ রোধে যান চলাচলের ক্ষেত্রে জোড়-বিজোড় পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টিপাত না থাকা, মগবাজার এলাকায় ফ্লাইওভারের কাজ, মেট্টো রেলের চলমান কাজসহ প্রায় সবজায়গায় বিভিন্ন রকম নির্মাণকাজ চলছে। বহুতল নির্মাণাধীন ভবন থেকে ধুলোবালি বাতাসে ভেসে আসছে। এসব কারণে বাতাসের একিউআই মাত্রা সহনশীল হচ্ছে না।’ অনেক ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের মহানগরীর অবস্থা আরও শোচনীয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ হাঁপানি রোগী রয়েছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি হলো শিশু। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতি বছর শহরে প্রায় ১৫ হাজার রোগীর অকালমৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এই বায়ু দূষণের প্রকোপ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায় তখন এসব হাঁচি, কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা হাজার অ্যান্টিবায়োটিক, ইনহেলার ও বিভিন্ন পদের ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হয় না, কারণ তাদের এ সমস্যার জন্য দায়ী ঢাকার বাতাস।
ধূমপান বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ। প্রতিদিন ঢাকা শহরের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ধূমপান করছে, যারা করছে তারা প্রতিদিন অন্তত পাঁচটি করে সিগারেট খায়, তাহলে হিসাব দাঁড়াল কত? আড়াই কোটি সিগারেট। পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনগুলো আইন অনুযায়ী ধূমপানমুক্ত রাখা সম্ভব হলে পরোক্ষ ধূমপানের কবল থেকে নারী শিশুসহ অধূমপায়ীদের রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এক একটা গাছ আপনার চারপাশে থাকা মানে এক একটা অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি আপনার চারপাশে থাকা, আপনার সন্তান বুকভরে নিঃশ্বাস নেবে। আমরা সরকারিভাবে কিংবা বেসরকারিভাবে উদ্যোগ ঢাকা শহরের ফুটপাতের যে ফাঁকা জায়গা বা আইল্যান্ড রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি বৃক্ষ লাগাতে পারি, যাতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।
আমাদের নিজেদের স্বার্থে এই শহরের বাতাস নির্মল রাখতে হবে, এর জন্য সেটা হলো সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা খুবই প্রয়োজন। শুধু আইন করে এই দূষণরোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের প্রতিটি বাড়ির ছাদে গাছ লাগানো উচিত। ঢাকা শহরের প্রতিটি ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাতে হবে, নির্মাণকাজ চলার সময় তা ঢেকে রাখতে হবে, পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে, রাস্তা খোঁড়ার সময় তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে, স্টিল, রিং-রোলিং কারখানা, ইটের ভাটা, সিমেন্ট কারখানার বস্তুকণা যেন পরিবেশে সরাসরি আসতে না পারে সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠুক নির্মল স্বাস্থ্যকর পরিবেশে। আমাদের পরমায়ু বৃদ্ধির জন্য নির্মল বায়ু নিশ্চিত হোক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট